হুমায়ূন আহমেদ: বহুমুখী প্রতিভার ইমেজ
লেখককে বাঁচিয়ে রাখেন পাঠক। আর পাঠক সত্তাকেও ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন লেখকরা। ঢাকার বাইরে বড় হওয়া এই আমার জন্য জাগতিক সীমাবদ্ধতা যেমন ছিল তেমনি ছিল মানবীয় উদারতা। খুব বেশি গল্পের বই, পাঠক পাঠাগার তখন ছিল না। ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাটিকে তাই দ্বিধাহীনভাবে পরিচিত গণ্ডিতে ভাগাভাগি করে নিতে শিখেছিলাম আমরা। ঢাকার বাইরে কমবেশি সব বাসাতেই আপনি হুমায়ূনকে পাবেন। শোকেসে সাজানো হাতেগোনা কয়েকটা বইয়ের মধ্যে মুচকি মুচকি হাসছে তার দু-একটি করে বই। তাই গল্পের জাদুকরকে খুঁজে আনতে হয়নি, লেখার জাদুর বলেই লেখক হুমায়ূনের সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। সেই পরিচয়ের কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই বলে আলাদা করে দিন তারিখের বালাই নেই। হাতের কাছে পেয়ে যেতাম বলে পড়া শুরু করেছিলাম। তারপর বইমেলা থেকে কিনে এবং বান্ধবীদের কাছ থেকে ধার করে পড়া। প্রথম মুগ্ধতা না পড়েই। ’৯৪ সালের দিকে আমার বড় বোন তার বইয়ের ভাঁজে তিথির নীল তোয়ালে নিয়ে পড়ছিল। নামটা কী সুন্দর! খুব পছন্দ হয়েছিল। তিথির নীল তোয়ালে কিংবা তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে। তখনও সেসব বই বড় হয়ে পড়তে পারার দূরত্ব নিয়ে বসবাস আমার।
৮০ কিংবা ৯০ দশকে যারা নতুন পাঠক কিংবা সাহিত্যের জগতে পথ চলতে শুরু করেছেন তাদের অনেকেরই প্রথমদিককার পড়া বইয়ের তালিকায় থাকেন হুমায়ূন। লেখার ভাষা, পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা, হিউমার, আবেগঘন অনুভূতির প্রকাশ, খুব টাচি সংলাপ, মানুষের অন্তর্গত সৌন্দর্যের সন্ধান, জটিলতামুক্ত সাধারণ চরিত্রের সহজবোধ্য উপস্থাপন পাঠককে দেয় পড়ার আনন্দ। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রথম প্যারাগ্রাফটা আপনাকে স্বাগত জানাবে একটা গল্প পাঠে। সংলাপনির্ভর গল্পে পরিমিত বর্ণনা আর চরিত্র চিত্রণে বাংলা সাহিত্যে তিনি অদ্বিতীয়। সহজবোধ্য জীবনযাপন এবং পরিচিত আবহ উপস্থাপন। চরিত্রগুলো আন্তরিক এবং সরল। বাঙালি চরিত্রে অবচেতনভাবে থাকা রোমান্টিসিজম এবং বাউন্ডুলে হতে চাওয়ার ইচ্ছা ভালোমতো ধরতে পারা এবং তা লেখায় তুলে আনা। ছিল বহুমুখী প্রতিভার ইমেজ।
নিয়মিত এবং সংক্ষিপ্ত কলেবরের উপন্যাস/গল্প লিখে যাওয়া হুমায়ূন আহমেদকে কখনও দীর্ঘ বিরতিতে যেতে দেখা যায়নি। এক বা দুই রাতের মধ্যে একটা উপন্যাস লিখে শেষ করতেন। মাঝেমধ্যে পরিকল্পনার বাইরে বেরিয়ে উপন্যাস শেষ করতেন। লিখতে লিখতেই নাকি শেষটা অন্যরকম হয়ে যেত। ‘হুমায়ূন বলতেন কেউ একজন তাকে দিয়ে এভাবে উপন্যাস শেষ করিয়ে নেয়’। ১৯৭২-এ নন্দিত নরকে দিয়ে যে পথচলা শুরু করেছিলেন জাগতিক নশ্বরতা সেখানে সংখ্যা স্থির করে দিলেও জনপ্রিয়তা এখনও তার সবচেয়ে বড় পাওয়া। সমসাময়িক লেখকদের তুলনায় তার বেশি মার্কেটিং সেন্স ছিল প্রখর। দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে তিনি লিখে গেছেন নিরন্তর। রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি থেকে যোজন দূরের হুমায়ূন আহমেদের বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। চরিত্রগুলোর অন্ধকার দিক কখনোই ওঠে আসেনি তার লেখায়। খেয়ালি লেখকের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর বেশিরভাগই খেয়ালি। অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোকেও তুলে এনেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। তবে এই নন্দিত লেখক ঠিকই পাঠকের মনের রসায়নে রেখেছেন স্থায়ী দাগ। তার অনবদ্য সৃষ্টি হিমু, শুভ্র আর মিসির আলী চির অম্লান। যদিও তিনি লেখক হিসেবে নারী চরিত্রদের কেবল অনুষঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এবং খুব বেশি চরিত্র ডিপ রুটেড না। সমাজ পরিবর্তন নয় বরং দিনের পর দিন মধ্যবিত্ত পারিবারিক জীবনের গল্প বলে পাঠককে মুগ্ধ করে রাখা হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কের সংলাপ লিখে গেছেন, সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট করে লিখে যাননি। সম্পর্কের অমীমাংসিত দুঃখবোধ নিয়ে লিখেছেন, সুখ খোঁজার রাস্তার সন্ধান দেননি। উপেক্ষা সহ্য করে অপেক্ষা করার অপরিসীম সাহস দিয়েছেন, নির্দিষ্ট করে সময়ের কোনও সীমারেখা টেনে দেননি। কিছু উপন্যাসে ডিটেইলস নেই এবং তার নির্মিত খুব বেশি চরিত্র ডিপ রুটেড না। পাঠকের আক্ষেপ দিয়ে লেখাটার ইতি টানছি। মানুষগুলো হারিয়ে যায় কিংবা লুকিয়া যায়, কিন্তু চাওয়াগুলো তো আর হারায় না। আমরা কি তেমন একটা অকপট লেখনীর মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সম্পূর্ণ জীবনীটা পেতে পারি একবার?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম অধ্যায়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।