উজানের ঢলে তছনছ সিলেটের ৬ উপজেলা
ওয়েছ খছরু-
বন্যায় তছনছ সিলেটের ৬ উপজেলা। ২০ দিন ধরে পানিবন্দি ৫ লাখ মানুষ। ২০০ স্কুল এখনো বন্ধ। কয়েক হাজার বাড়িঘর পানির নিচে। রাস্তা থেকে পানি নামলেও যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। ভেঙে গেছে প্রায় ২০০ কিলোমিটার রাস্তা। খাবার সংকট চলছে। প্রশাসন থেকে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। এদিকে আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। দিনে পানি নামলেও অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে রাতে আবার বাড়ছে। হাওরপাড়ে তীব্র বাতাসের কারণে বহু বাড়িঘর হুমকির মুখে পড়েছে। প্রশাসনের হিসাব মতে সিলেটে এবার বন্যা দেখা দেয় ২২শে জুন থেকে। উজানের ভারি বর্ষণ হওয়ার কারণে কুশিয়ারা নদীর পানি রমজানের শেষ দিকেই বিপদসীমা অতিক্রম করে। প্রবল বেগে পানি আসার কারণে মাত্র ৩ দিনেই কুশিয়ারা তীরবর্তী জকিগঞ্জের একাংশ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর পানিতে তলিয়ে যায়। রাস্তাঘাট ডুবে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এই ৬ উপজেলা। পরবর্তীতে বন্যা আঘাত হানে দক্ষিণ সুরমার তিনটি ইউনিয়নে।
ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ সদরের বাজার সহ অন্তত ১০টি বাজার পানিতে তলিয়ে যায়। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ সদর থেকে পানি নামলেও বাজারের নিম্ন এলাকা নিমজ্জিত রয়েছে। তবে পানি দিনে কমলেও রাতে বাড়ছে। কোনো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই এ দুটি উপজেলা সদরে। এজন্য বন্যা হলেই কুশিয়ারা নদীর পানি আছড়ে পড়ে বাজারে। গোলাপগঞ্জ ও বালাগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দাল মিয়া জানিয়েছেন, বন্যার পানি নামছে না। এ কারণে যেসব গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল সেগুলোও গেল ২০ দিন ধরে একই অবস্থায় রয়েছে। এতে করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। প্রশাসন সহ ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান। ওসমানীনগরের সাদিরপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রব জানিয়েছেন, তার এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এখনো বেশির ভাগ এলাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বন্যা স্থায়ী রূপ নেয়ায় পানিবন্দি মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। বিশুদ্ধ পানির সংকট চলছে। নিম্ন এলাকার বহু মানুষ বাঁশের মাচা তৈরি করে বসবাস করছেন। পানি না কমলে তারা আশ্রয় কেন্দ্রে এসে ওঠার চিন্তা-ভাবনা করছেন। কারণ যারা পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন তারা অনাহারে- অর্ধাহারে বসবাস করছেন।
ওসমানীনগরের সুরিকোনা গ্রামের পানিবন্দি মানুষজন জানিয়েছেন, তাদের গ্রাম প্রায় বিচ্ছিন্ন। যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। আর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করায় অনেক মানুষই ত্রাণ পাচ্ছে না। সিলেটের দুই শতাধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল খুলে দেয়া সম্ভব হয়নি। পানি রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে পানি নামলেও সেগুলোতে ক্লাস নেয়ার উপযোগী নয়। এ কারণে এখনো বন্ধ রাখতে হয়েছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চলতি দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাও পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্যায় যে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো সংস্কার করেই ক্লাসে ফিরতে হবে। সেই প্রস্তুতি ইতিমধ্যে রাখা হয়েছে। কিন্তু পানি না কমার কারণে তারা সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারছেন না। সিলেটে নিজ এলাকায় সফরকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও সে বিষয়টি সরজমিন দেখেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও বন্যায় সিলেটে প্রায় ৫০০ হেক্টর ফসলি জমির ফসল তলিয়ে গেছে। বোরোর পর আমন ধান তলিয়ে যাওয়ার কারণে খাবার সংকট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। পানি না নামার কারণে কৃষক নতুন করে আশায় বুক বাঁধতে পারছেন না। গোলাপগঞ্জের কুশিয়ারা তীরবর্তী এলাকার কৃষক আতর আলী, আব্দুল আলী সহ কয়েকজন জানিয়েছেন, বন্যার পানি নামলেই তাদের কাছে বীজ ও চারা সরবরাহ করতে হবে।
নতুবা তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এদিকে সিলেটে বন্যায় তছনছ হয়ে গেছে প্রায় ২০০ কিলোমিটার রাস্তা। এসব রাস্তার অর্ধেকের বেশি এখন পানিতে নিমজ্জিত। ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়কের সংস্কারে ৫০ কোটি টাকা লাগবে বলে জানিয়েছে এলজিইডি। বন্যায় সিলেটের নয় উপজেলার গ্রামীণ সড়কগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সিলেট এলজিইডি অফিস জানায়, জেলার প্রায় ২১৬ কিলোমিটার সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া সড়ক ও জনপথের আওতাধীন আরো ৬ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়কের কোথাও কার্পেটিং ওঠে, কোথাও ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিয়ানীবাজার উপজেলার প্রায় ৪৯ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। এছাড়া বন্যায় বালাগঞ্জে ৪০ কিলোমিটার, সিলেট সদরে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার, গোয়াইনঘাটে প্রায় ৩১ কিলোমিটার, গোলাপগঞ্জে প্রায় ২২ কিলোমিটার, কোম্পানীগঞ্জে ১৮ কিলোমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে ১৫ কিলোমিটার, জকিগঞ্জে প্রায় দুই কিলোমিটার ও ওসমানীনগরে ২ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এএসএম মহসিন জানিয়েছেন, এলজিইডির আওতাধীন প্রায় ২১৬ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক সংস্কারে প্রয়োজন ৫০ কোটি টাকা। আমরা ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। বন্যা পরিস্থিতি দেখতে গত ৪ঠা জুলাই সিলেট সফর করেন ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ওই সময় সিলেটে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বিশেষ সভায় সচিব শাহ কামালকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, সেতু ও কালভার্ট সংস্কারে প্রকল্প নিয়ে দ্রুত টেন্ডারের নির্দেশ দেন ত্রাণমন্ত্রী।