আইএমএফের ঋণ এখন গলার কাঁটা
১৬ শর্তের বেশির ভাগ শিল্পবিরোধী
আর্থিক নীতি, মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার, আর্থিক খাত ও বিনিয়োগ খাত সংস্কারে আইএমএফের শর্তগুলো হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি হ্রাস, কর অবকাশ সুবিধা কমানো, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি, মূল্য সংযোজন কর আইন সংশোধন ও বাস্তবায়ন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করা, রফতানিমুখী বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ হ্রাস, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে নিয়ে একটি সমন্বিত তদারক কাউন্সিল গঠন, স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশন, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (এসইসি) শক্তিশালী করার পদক্ষেপ, সামাজিক ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল গঠন, আন্তর্জাতিক একটি নিরীক্ষা ফার্ম (অডিট ফার্ম) দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট কার্যক্রম এবং সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হারসহ ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ প্রভৃতি।
এসব শর্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে সময়ে এ ঋণটা নেয়া হয়েছে, ওই সময় বিশ্বের অনেক দেশই তাদের আর্থিক খাত নিয়ে চাপে ছিল। সবাই কিন্তু এ ঋণ নেয়নি। তিনি দাবি করেন, বিনাসুদে হলেও আইএমএফের কাছ থেকে কঠিন শর্তযুক্ত এ ঋণ নেয়াটাই সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এখন ঋণ যেহেতু নিয়েছে, শর্তের বাস্তবায়ন করতে তো হবেই। সেটা করতে হলে জনজীবনে ভোগান্তি আসবেই।
অন্যদিকে আইএমএফের শর্তের বিষয়টি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সেই ২০১২ সালেই অস্বীকার করেছেন। তিনি তখন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যেসব শর্তের কথা বলা হচ্ছে, সেসব শর্ত আইএমএফের নয়। বরং আমিই দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির কথা ভেবে আমাদের আর্থিক খাতে বেশ কিছু সংস্কার আনার প্রস্তাব আইএমএফকে জানিয়েছিলাম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১২ সালের ১৩ এপ্রিল এক্সটেনডেট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) ঋণ নেয়ার পরপরই এ দাতা সংস্থার শর্ত পূরণে তোড়জোড় শুরু করে সরকার। এসব শর্তের ধরন ও বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাষ্ট্র ঋণ নিলেও এর ব্যয়ভার সহজেই যাতে জনগণ থেকে তুলে আনা যায়Ñ এমন শর্ত বাস্তবায়নের দিকেই সরকার বেশি মনোযোগী।
এর ধারাবাহিকতায় গত দুই বছরে জ্বালানি-বিদ্যুতের স্থানীয় দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়। এ কারণে উদ্যোক্তার উৎপাদন ব্যয় গড়ে ৮ ভাগ বেড়েছে। পরিবহন ব্যয় ও পণ্যমূল্যও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কমিয়ে আনা হয় স্থানীয় শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা। এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে শূন্য দশমিক ৫ ভাগ অর্থ বা প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার বাড়তি বোঝা জনজীবনে যোগ হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ভর্তুকিও কমানো হয়েছে। এতে সক্ষমতা হারিয়েছে অনেক উৎপাদনমুখী খাত। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) নানামুখী আগ্রাসী তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে।
এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে করদাতার ওপর। শর্ত পালন করতে গিয়ে সরকার গত তিন বছর ধরেই ঢাকঢোল পিটিয়ে আসছে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন কার্যকর করার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়নের বছরে এসে দেশের প্রকৃত বাস্তবতা বুঝতে পেরে এ আইন কার্যকর থেকে দু’বছর পিছু হটে সরকার। এ পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দায় স্বীকার করে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, এখনই ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের দিকে যাওয়া এনবিআরের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এখানে আমার (অর্থমন্ত্রী) আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, সরকারের কাজ হচ্ছে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। বিদেশি প্রতিষ্ঠান আইএমএফের শর্ত পূরণ করা নয়। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন প্রশ্নে সরকার দেশের বৃহৎ কল্যাণ, জনগণ ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সঠিক কাজটিই করেছে। তবে আইএমএফের বেশ কিছু শর্ত দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করার জন্য সহায়ক হলেও সরকারের দায়িত্বশীলরা তাতে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কারণ সেসব জনগুরুত্বপূর্ণ শর্তের বাস্তবায়ন করতে গেলে সুবিধাভোগীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাবে এবং দু’হাতে অর্থ লোপাটের পথ বন্ধ হবে।
ফলে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হারসহ ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে নিয়ে একটি সমন্বিত তদারক কাউন্সিল গঠন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কার এবং বাণিজ্য উদারীকরণ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর মতো শর্তগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি কম। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যখন বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ নিয়েছিল সেই সময় আর বর্তমানের প্রেক্ষাপট এক নয়।
দেশের অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেয়া আইএমএফের কিছু শর্ত বাস্তবায়ন দেশের জন্যই সহায়ক ছিল। কিন্তু সরকার সেটি পরিপূর্ণভাবে করতে পারলে আর্থিক ভিত্তি মজবুত হতো। অন্যদিকে যেসব শর্ত ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে তার কিছু নেতিবাচক প্রভাব জনজীবনে পড়ছে। এ থেকে উত্তরণে তিনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কিভাবে বাড়ানো যায়, দ্রুত সেদিকে নজর দেয়ার পাশাপাশি অধিক হারে কর্মসংস্থান তৈরিরও পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে ভ্যাট আইন কার্যকরের সময় এখনও হয়নি মন্তব্য করে তিনি সরকারের পিছু হটে আসাকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলেই মনে করেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশই প্রথম দেশ যারা ইসিএফ কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ হওয়া এ ঋণের প্রকৃত অর্থের পরিমাণ মাত্র ৯৬.৪০ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এক বিলিয়নেরও কম। সেটাও আবার দেয়া হয়েছে ৭টি কিস্তিতে। অথচ দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করছে।