পদত্যাগ করলেন নওয়াজ শরীফ
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট থেকে অযোগ্য ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টার মাথায় পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় পাকিস্তানের টালটামাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও টালমাটাল হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। ২৮ জুলাই শুক্রবার পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের পর নওয়াজ ও তার পরিবারের বিপুল পরিমাণ সম্পদের হিসাব দিতে না পারার পর আদালত এ অভিযোগ করা মামলার আলোচিত এ রায় দেয়। একই সঙ্গে নওয়াজ শরীফ, তার মেয়ে মরিয়ম এবং তার স্বামী সফদর, অর্থমন্ত্রী ইশরাক দারসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়েরের পরামর্শ দিয়েছে আদালত।
রায়ে সর্বোচ্চ আদালত পাকিস্তানের দুর্নীতি দমন সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি ব্যুরোকে (এনএবি) ছয় সপ্তাহের মধ্যে মামলার আসামি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তার সন্তানদের বিরুদ্ধে একটি রেফারেন্স দায়েরের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ছয় মাসের মধ্যে বিচার শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মামলার রায়কে ঘিরে ইসলামাবাদের আদালত প্রাঙ্গণে বিপুলসংখ্যক পুলিশ এবং আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। কিছুদিন আগে এক বিশেষ তদন্তে উঠে আসে যে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা তাদের অর্থনৈতিক সম্পদের হিসেব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
২০১৫ সালে পানামা পেপারস ফাঁসের পর জানা যায়, শরীফের সন্তানরা বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত রয়েছে। পাঁচজন বিচারকের বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে এই রায় দেন। ওই বেঞ্চের পাঁচ সদস্য হলেন—বিচারপতি আসিফ সাঈদ খোসা, বিচারপতি এজাজ আফজাল খান, বিচারপতি গুলজার আহমেদ, বিচারপতি শেখ আজমত সাঈদ ও বিচারপতি ইজাজুল আহসান। রায় পড়ে শোনান বিচারপতি এজাজ আফজাল।
গত বছর ফাঁস হওয়া পানামা পেপারসে নওয়াজ শরীফের মেয়ে মরিয়ম ও ছেলে হাসান-হুসেনের নাম আসে। তারা তিনজন ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত বিভিন্ন অফশোর কোম্পানির নামে লন্ডনে সম্পত্তি কিনেন বলে ফাঁস হওয়া নথিতে বলা হয়। এরপরই বিরোধীরা নওয়াজ পরিবারের সম্পত্তির হিসাব ও দুর্নীতির তদন্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের কাছে দাবি জানায়। গত জুনে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট জানায়, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অপসারণ করার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলেনি। নওয়াজ পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে আদালত একটি যৌথ দল গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয় সেসময়।
সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক এজাজ আহমেদ খান বলেছেন, নওয়াজ শরীফ এখন আর ‘একজন সৎ সংসদ সদস্য হিসেবে কাজ করার যোগ্য নন’। আর রায় মেনে নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান। পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। নওয়াজ শরীফ ও তার সন্তানরা শুরু থেকেই তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। পরিবারের সব সম্পত্তিই বৈধ উপায়ে কেনা বলেও তাদের দাবি। যৌথ তদন্ত দলের (জেআইটি) জিজ্ঞাসাবাদেরও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও তার সন্তানরা একই কথা বলেন।
পাকিস্তান মুসলিম লীগ- নওয়াজের (পিএমএল-এন) দলের নেতা নওয়াজ শরীফের বাবা ছিলেন দেশটির খ্যাতিমান শিল্পপতি। এর আগে ১৯৯০ ও ১৯৯৯ সালে দুইবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় কোনোবারই তিনি মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। দ্বিতীয়বার সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশান্তরিত হয়েছিলে নওয়াজ। তখন বেশিরভাগ সময় তিনি থাকতেন সৌদি আরবে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসেন তিনি।
ইমরানের আল্লাহকে ধন্যবাদ
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে নওয়াজ শরিফকে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট অযোগ্য ঘোষণা করার পর আল্লাহর দরবার হাত তুলে ধন্যবাদ জানিয়েছেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির চেয়ারম্যান ইমরান খান। ২০১৫ সালে পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় শুক্রবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। পাকিস্তানের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এ রায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রার্থনা করেন ইমরান। পাঁচ সদস্যের বিচারপতির বেঞ্চ শুক্রবার এ রায় দিয়েছেন। বহুল আলোচিত এ রায় ঘিরেই সারা বিশ্বেরই সতর্ক দৃষ্টি ছিল পাকিস্তানের দিকে। দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়।
কোন পথে পাকিস্তান?
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির মামলায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নওয়াজ শরীফকে দৃশ্যত সরিয়ে দিয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। আগামী বছর নির্বাচনের আগেই ইতি ঘটলো নওয়াজ শাসনের। এ নিয়ে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারল না।পাকিস্তানের বেশিরভাগ প্রধানমন্ত্রীর শাসনের ইতি ঘটেছে দেশটির শক্তিশালী সুপ্রিম কোর্ট কিংবা সেনাবাহিনীর হাতে। আবার অনেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন কিংবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এখন নওয়াজ শরীফের পদত্যাগের পর কি কি হওয়ার সম্ভাবনা সেটা নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে কথা বলা হয়েছে।
প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে দায়িত্বচ্যুত হলেও নওয়াজ শরীফ এখনো পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এর প্রধান রয়ে গেছেন। সংসদের ৩৪২টি আসনের মধ্যে ২০৯ টি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নওয়াজের পিএমএল-এন। তাই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ে নওয়াজের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা যাবে। অবশ্য বিরোধী দলগুলোও তাদের পছন্দের প্রার্থী দিতে পারে। কিন্তু সংসদের সে প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সংসদে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন প্রক্রিয়া চলবে।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান এর আগেও এরকম দৃশ্য দেখেছে। ২০১২ সালে ইউসুফ রাজা গিলানীকে পদচ্যুত করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল। কারণ, তিনি দেশটির তত্কালীন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চালু করতে অপারগতা জানিয়েছিলেন।
তৃতীয়ত, আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা আছে কি? আগাম নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই মনে হচ্ছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি সেটা ঘোষণা দিতে পারেন। এখন নওয়াজ শরীফের উত্তরসূরী নির্বাচন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তারপর সে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিলে আগাম নির্বাচন হতে পারে। তবে সেটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ আগামী নির্বাচন ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তাই সেটা এগিয়ে আনার কোন প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে না।
চতুর্থত, সেনাবাহিনী কি আবার ক্ষমতায় আসছে? স্বাধীনতার গত ৭০ বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় ক্ষমতা ছিল সেনাবাহিনী। তাই এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী আবার দাঁত বসাবে কিনা সেটা নিয়ে আশঙ্কা স্বাভাবিক।
তবে খুব কম লোকই এটা প্রত্যাশা করে, সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতায় বসছে। তাছাড়া ক্ষমতায় না বসেই যদি ক্ষমতার মধু খাওয়া যায়, প্রভাব ফেলা যায় তাই ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই সেনাবাহিনীর। সেনাবাহিনী এরই মধ্যে দেশটির পররাষ্ট্র নীতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের এশিয়া প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘সেনাবাহিনীর তো ক্ষমতা নেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। তারা দৃশ্যের আড়ালে থেকে ক্ষমতার অনেক মধু ভোগ করে।’ক্ষমতার মসনদে সামরিক বাহিনীর আগমণের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দিয়ে মাইকেল কুগেলম্যান জানান, পাকিস্তানের জনগণ মার্শাল ল’র পক্ষে নয়।
কে হচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী?
সুপ্রিম কোর্ট অযোগ্য ঘোষণার পরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন নওয়াজ শরীফ। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, আদেশের বিষয়ে ‘আপত্তি’ থাকলেও নওয়াজ শরীফ সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি সন্মান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়েছেন। এরপর থেকে কে হচ্ছেন দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী, তা নিয়ে জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছে। পদ ছাড়লেও নওয়াজ শরীফ তার উত্তরসূরি বাছাইয়ে ভূমিকা পালন করতে পারবেন। কারণ তিনি ক্ষমতাসীন পিএমএল-এন দলটির প্রধান।অবশ্য তার দল থেকে মনোনীত প্রার্থীকে প্রধানমন্ত্রী হতে হলে ভোটের জন্য সংসদে দাঁড়াতে হবে। অবশ্য নওয়াজ শরীফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন) সংসদে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তার মনোনীত প্রার্থীরই পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাকিস্তানের এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের খবরে বলা হয়, মেয়ে মারিয়াম নওয়াজকে নিজের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে ভেবে আসছিলেন নওয়াজ। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী পদে তাকে লড়তে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ তিনি নির্বাচিত কোনো সংসদ সদস্য নয়। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্ভাব্য বেশ কয়েকজনের নাম আসছে। এর মধ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন নওয়াজ শরীফের ভাই শাহবাজ শরীফ। এটি হলে তাকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়বে হবে। এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। আরেকজন সম্ভাব্য হিসেবে ভাবা হচ্ছে, জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশুনা শেষ করা ও শরীফ পরিবারের খুব কাছের লোক হিসেবে পরিচিত সংসদ সদস্য আহসান ইকবালও আছেন এই তালিকায়। বর্তমানে তিনি দেশটির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন।
এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পিএমএল-এন’র শক্ত সদস্য চৌধুরী নিসার আলী খানও রয়েছেন তালিকার প্রথম দিকে।শাহবাজ শরীফের দায়িত্ব গ্রহণের আগে অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পালন করতে পারেন উপরের যে কোনো একজন। ভাই শাহবাজ শরীফের হাতে ক্ষমতার রশি থাকলে শরীফ পরিবার নিরাপদ বোধ করবে, সেটা বলাই বাহুল্য। এদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেমন হবেন শাহবাজ শরীফ, সেদিকে ইঙ্গিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহবাজ অনেক বুদ্ধিমান হলেও বড় ভাইয়ের মতো ক্যারিশমাটিক নন।