সেই অনুভুতি এখনও জীবন্ত
ফাতেমা চৌধুরী স্বপ্না(ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)-
1987 সালের কথা। সবেমাত্র দেশ ছেড়ে আমেরিকা এসেছি। সারাক্ষন দেশকেই মনে পড়ে, ঘুমুলেও দেশের স্বপ্ন দেখেই জেগে উঠি। ঝলমলে রোদের মাঝেও মনের আকাশে সব সময় একখন্ড মেঘ ভেষে বেড়ায়। সেখান থেকে যখন তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টিও ঝরে। সবই আছে তবুও কেমন যেনো একটা অপূর্নতা। মন ভালো করার জন্য আমার স্বামী এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যান, তবু মন আমার পুরোপুরি ভালো হয় না। বাইরে বের হই, কিন্তু কোনো বাংগালী দেখি না। বাংলা কথা শুনি না। মন আরও খারাপ করে ঘরে ফিরি। শুধু নিজ ঘর আর দু’চার পরিবার আত্মীয় স্বজন এবং দু’একটি বন্ধু পরিবার। একলা সময়টুকু কাটে দেশে চিঠি লিখে আর দেশের চিঠি পড়ে পড়ে।
কাছের একটা গায়ানিজ ভিডিও ষ্টোর থেকে প্রায়ই হিন্দি মুভির ক্যাসেট আনতে গিয়ে বাংলা খুঁজতাম কিন্তু না পেয়ে হতাশ মনে হিন্দি নিয়েই ঘরে ফিরতাম। তবু বাংলা খোঁজাটা অব্যাহতই থাকতো। টিভিতে এতো চ্যানেল কিন্তু একটাও বাংলা নেই। বাংলা চ্যানেলের কথা তখন ভাবাই যেতো না। ‘প্রবাসী’ এবং ‘ঠিকানা’ নামে মাত্র কয়েক পৃষ্টার দু’টো সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা বের হতো, তাও কাছাকাছি পাওয়া যেতো না। দূরত্বের জন্য সময়ের অভাবে প্রতি সপ্তাহে আনাও সম্ভব হতো না। যখনই ওদিকে যাওয়া হতো আনতে ভূলতাম না। মনে আছে একদিন একটি ইন্ডিয়ান গ্রোসারীতে ঈদ সংখ্যা ‘দেশ’ পত্রিকা দেখে যেনো হাতে আকাশের চাঁদ পেয়েছিলাম। কি যে খুশী! পাঁচ ডলার দিয়ে কিনে নিলাম। একই লেখা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার পড়তাম। এমনি ছিলো তখনকার সময়। মাঝে মধ্যে থিয়েটারে ইংরেজী মুভি দেখতে যেতাম, ভালো লাগলেও দেশীয় বাংলা মুভি খুব মিস্ করতাম।
এমনি সময়ে চৌধুরী সাব(আমার স্বামী) একদিন ঘরে ফিরে বললেন নায়ক রাজ রাজ্জাক নাকি নিউ ইয়র্ক আসতেছেন। কিছু সংখ্যাক বাংগালীর উদ্যোগে উনাকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজনও হবে। কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে তিনি খবরটা জেনেছেন। শুনেতো খুশীতে পাগল হওয়ার অবস্থা। যেভাবেই হউক ঐ অনুষ্টানে যাওয়া চাই। দেশীয় ছবির নায়ক বলতেই আমার কাছে তখনও নায়ক রাজ রাজ্জাক। ছোটবেলায় উনার অভিনীত ছবি দেখেই ছবি দেখা শুরু। সব সময় তো আর দেখা হতো না, মাঝে মধ্যে, কিন্তু প্রিয় অভিনেতা উনিই আর প্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে শাবানা মনে গেঁথে গিয়েছিলেন। সেই রেশ তখনও সারা মন জুড়ে। সময় যেনো আর কাটছিলো না। অবশেষে সেই কাংখিত দিন এলো। বিকেলের দিকে আমি, যীশু আর চৌধুরী সাব অনেক আগ্রহ নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই অনুষ্টান স্থলে পৌঁছে গেলাম। ম্যানহাটনের ছোট্ট একটা থিয়েটার হলে অনুষ্ঠানের আয়োজন। সল্প সংখ্যাক বাংগালী দর্শক। অধীর আগ্রহ নিয়ে যার যার সিটে বসে আছি। কখন নায়ক রাজ ষ্টেজে উঠে আসবেন সেই অপেক্ষায় এক মুহুর্তের জন্যও স্টেজ থেকে চোখ ফেরাচ্ছি না।
উপস্থাপকের ঘোষনার সাথে সাথে মনযোগ আরও সুদৃঢ হলো। কতদিন পার হয়ে গেছে কিন্তু অফ হোয়াইট স্যুট পরা কল্পনার নায়কের বাস্তব উপস্থিতি এখনও চোখে স্পষ্ট। কি যে আবেগঘন মুহুর্ত! তিনি স্টেজে এসে উপস্থিত প্রবাসীদের সংগে কোশল বিনিময় করলেন এবং নতুন মুক্তি পাওয়া তার একটা ছবি নিয়ে সংকিপ্ত বক্তব্যও রাখলেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি, দেখছি। উনার অভিনীত ঐ ছবিটি নিয়েই তিনি সেবার এসেছিলেন,উদ্দেশ্য এখানে দর্শক প্রিয়তা যাচাই করা,দর্শক সৃষ্টি করা। অনুষ্টানের এক পর্যায়ে ছবিটিও প্রদর্শিত হয়েছিলো। ছবিটির নাম এখন আর মনে পড়ে না। মনে আছে বক্তব্য শেষে নায়ক রাজ স্টেজ থেকে নেমে ঘুরে ঘুরে একজন একজন করে উপস্থিত সকল দর্শকের সংগে হাত মিলিয়েছিলেন এবং কোশল বিনিময় করেছিলেন। যখন কাছে এলেন, খুশীতে আবেগে হাত কি আমার কাঁপছিলো! হয়তো! কত বছর আগেকার কথা, কিন্তু সেই অনুভুতিটুকু এখনও অনেকটাই জীবন্ত। মনে আছে একরাশ ভালোলাগা নিয়ে সেদিন ঘরে ফিরেছিলাম।
এই সময় আর সেই সময়। এখন তো সব কিছুই সহজলভ্য। এখনও মাঝে মাঝে নায়ক রাজের অভিনীত পুরানো ছবি দেখি। কখনও বাংলা চ্যানেলের প্রচারনায় আর কখনও ইউ টিউব থেকে খুঁজে নেই। ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ে সুনামগন্জের সেই একটিমাত্র ছোট্ট সিনেমা হল নূরজাহানের কথা, ছোটবেলার কথা। সকালে টিভি খুলতেই পেয়ে যাই এক মন খারাপ করা সংবাদ। নায়করাজের মৃত্যূসংবাদ। দূর প্রবাসে থাকলেও নায়করাজের মৃত্যূসংবাদটি আমাদেরও শোকাহত করেছে। এই কিংবদন্তী অভিনেতার রুহের মাগফেরাত কামনা করি। চলে গেলেও আমাদের হৃদয়ে সেই একই রকমভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন। আল্লাহ্ উনাকে বেহেস্ত নসিব করু,আমিন।