ছাতকে আ.লীগের দুই পক্ষে উত্তেজনা, জনমনে আতঙ্ক
মাহবুব আলম-
ছাতকের সিংচাপইড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন মো. সাহেল’র (৪০) বিরুদ্ধে ছাতক থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়েরকে কেন্দ্র করে ছাতক উপজেলা আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এনিয়ে দলীয় নেতাকর্মীসহ জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ছাতকের জনপ্রতিনিধিরাও এ ঘটনায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের সমর্থক ছাতকের ৮ ইউপি চেয়ারম্যান এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান যৌথভাবে ইউপি চেয়ারম্যান সাহেলকে সন্ত্রাসী এবং সরকারের উন্নয়নের বিরোধী আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন করছেন।
অন্যদিকে, ছাতক পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী’র সমর্থকরা সাহেলকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জড়ানো হয়েছে দাবি করে কর্মসূচি পালন করছেন। এই নিয়ে ছাতক উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে।গত ১৩ আগস্ট ছাতক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবু ছাদাত লাহিনসহ ৮ জন জনপ্রতিনিধি স্বাক্ষরিত জেলা প্রশাসকের নিকট দায়ের করা আবেদনে উল্লেখ করা হয়-‘ছাতক উপজেলার সিংচাপইড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপজেলার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে উপজেলা পরিষদের প্রথম পরিচিতিমূলক সভা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ১০ আগস্ট মাসিক সমন্বয় সভায় হাতাহাতির মত ঘটনা ঘটিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে আসছে সাহেল। এর আগে গত ২ আগস্ট সাহেলের অনিয়ম দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে আবেদন করায় ঐ ইউপি’র ৩ সদস্যকে নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে।’
লিখিত আবেদনে এসব জনপ্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন, ‘সাহেলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের দ্রুত প্রতিকার পাওয়া না গেলে পরিষদের কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখা আমাদের জন্য অসম্ভব, তেমনি ভয়ভীতি নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’ লিখিত আবেদনকারীরা হলেন- ছাতক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবু সাদাত মোহাম্মদ লাহিন, ইউপি চেয়ারম্যান গয়াছ আহমদ, মো. শায়েস্তা মিয়া, মো. আওলাদ হোসেন, বিল্লাল আহমদ, মো. মুরাদ হোসেন, আব্দুল মছব্বির ও আব্দুল হেকিম।
এদিকে, ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপর হামলা ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছাতক থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা (১৫(০৮)১৭) দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ একজন আসামীকে গ্রেপ্তার করেছে। এই মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান সাহেলসহ ৭ জনকে আসামী করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন- উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক উত্তর খুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিল্লাল আহমদ।মামলা দায়েরের পর থেকে ছাতক উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী চলছে।
মঙ্গলবার সিংচাপইড় ইউনিয়নের খামারগাঁওয়ে সাহেলের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিচারের দাবিতে এক পক্ষ খাসগাঁও বাজারে এবং সাহেলের মুক্তির দাবিতে আরেকপক্ষ ইউনিয়নের কালীপুর পয়েন্টে মানববন্ধন করে। মানববন্ধন চলাকালে সাহেল সমর্থিত লোকজন মোটরসাইকেল যোগে খাসগাঁও বাজারে মহড়া দিলে দু\’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে বাধে।
ইউপি চেয়ারম্যান সাহেলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী উত্তর খুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিল্লাল আহমদ বলেন- ‘ছাতক পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম চৌধুরীর ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে সাহেল একের পর এক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তার আচরণে উপজেলা সমন্বয় সভায় বসা যায় না। কর্মকর্তারাও অতিষ্ট, বাধ্য হয়ে মামলা দায়ের করেছি। সাধারণ মানুষসহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাও তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।’ ইউপি চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন সাহেলের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় এসব বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি। ছাতক পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম চৌধুরী দেশের বাইরে। ভারপ্রাপ্ত মেয়র তাপস চৌধুরী বলেন,‘সাহেল কোন সরকারী কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করেছেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ বা মামলা হয়নি। সাহেলকে দমানোর জন্য এই মামলা হয়েছে।’
আবুল কালাম চৌধুরী’র ভাই শামীম চৌধুরী বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান সাহেলকে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা বিজিত রঞ্জন কর সিংচাপইড় ইউনিয়নের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্বাচনে জাল ভোটার প্রস্তুত করায় সাহেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। পরে শেষ হয়েছে। ছাতক উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এমএ করিম (বর্তমানে দোয়ারাবাজার উপজেলায় কর্মরত) সাহেলের কাছে কমিশন চাওয়ায় মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এমএ করিমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা বিজিত রঞ্জন কর বলেন,‘সাহেল কেবল আমার সঙ্গে নয়, সবার সঙ্গেই খারাপ আচরণ করেছে। আমার বিষয়টি পৌর মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী পরে শেষ করে দিয়েছেন।’ছাতক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অলিউর রহমান চৌধুরী বকুল বলেন,‘ইউএনও খবর দিয়ে সিংচাপইড় ইউপি’র ৩ জন সদস্যকে সমন্বয় করে দেবার জন্য অফিসে ডাকেন। ঐ সময়ও ইউপি সদস্যগণ মারপিঠের শিকার হন। পরবর্তীতে আরেকদিন মাসিক সভায় সাহেল অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক এ প্রসঙ্গে বলেন,‘২০০০ সালের ১৬ আগস্ট খুরমা উচ্চ বিদ্যালয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আমার উপর গুলি হয়েছিল। সিংচাপইড় ইউপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুল খালিক ঐ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। গুলি করার মূল আসামী ছিল সাহাব উদ্দিন সাহেল। সিংচাপইড়সহ ঐ এলাকায় শাহীন, আব্দুস সালাম ও সাহেলের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। আমি শামীম চৌধুরী’র কথা’র জবাব দিতে চাই না। আমার নির্বাচনী এলাকায় ২২ টি ইউনিয়ন ১ টি পৌরসভা রয়েছে। ১০০ জনের বেশি জনপ্রতিনিধি আমার রাজনৈতিক জীবনে ঐ অঞ্চলে নির্বাচিত হয়েছেন, আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। আমি কারো বিরুদ্ধে কূটকৌশল কিংবা অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছি, এটি বলতে পারবেন না।’
সাহাব উদ্দিন সাহেলের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিদের দায়ের করা লিখিত অভিযোগ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন- ‘ইউপি চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন সাহেলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুলিশ সুপার সাহেবের কাছে পাঠিয়ে এই বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। এছাড়া সে যেহেতু একজন ইউপি চেয়ারম্যান স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালককে এ বিষয়ে তদন্তের জন্য বলা হয়েছে।’ সহকারী পুলিশ (ছাতক সার্কেল) মো. দোলন মিয়া বলেন- ‘সাহেলসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা দ্রুত বিচার আইনের মামলায় একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। আমরা অন্যদের খুঁজছি।’