শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল চাকরি লাভ কিংবা ব্যক্তিগত উন্নতি নয়; এ কথা বইয়ে মাঝেমধ্যে পড়েছি। স্কুলের সিলেবাসে প্রমথ চৌধুরীর বইপড়া নামের একটি প্রবন্ধ ছিল। তারপর মুজতবা আলী’র বইকেনা পড়েছি। আরও বড় হয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞান অর্জন এবং দেশ ও মানুষের প্রতি আত্মত্যাগে নিজেকে প্রস্তুত করা- ঠিক এমন কথা বুঝেছি এবং বুঝিয়েছি; কিন্তু চাকরির বিষয়টি আমরা কয়জন মাথা থেকে সরাতে পারি? অথচ শিক্ষার্থীরা হচ্ছে একেকটি আলোকস্তম্ভের মতো, তারা আলোকিত হলে দেশ আলোকিত হবে। নিজেকে কোন কাজের জন্য আমরা প্রস্তুত করি, তা না জেনেই বড় হতে থাকি। আর তারপর সেই বেকারত্ব। শিক্ষাগ্রহণ, নিজেকে স্বপ্নের সমান করে গড়ে তোলা আর কার্যকর হাতে কলমে যোগ্য হলে আজকের অবস্থার সৃষ্টি হতো না হয়তো। আমাদের সকালগুলো সত্যিকারের রোদ বিছানো সকাল হোক সেটাই কিন্তু সবাই চাই; আর তার জন্য দরকার প্রকৃত শিক্ষা।

অনেক দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ শিক্ষার  উদ্দেশ্যে বর্ণনা করে গেছেন। প্রাচীন দার্শনিক এরিস্টোটল, সক্রেটিস ও  প্লেটো শিক্ষার তাৎপর্য বর্ণনা করে গেছেন। সেই থেকে পরবর্তী সকল যুগের চিন্তাবিদরাই শিক্ষা সম্পর্কে কথা বলেছেন।  আল কুরআন থেকে জানা যায়, নবীগণ শিক্ষা প্রচারের  উদ্দেশ্যেরই প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁরা শিক্ষার তাৎপর্য এবং লক্ষ্য উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে নিজ নিজ জাতির সামনে পেশ করেছেন। সর্বেশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর  উপর অবতীর্ণ আল কুরআন এবং তাঁর নিজের বাণী হাদীস থেকে শিক্ষার তাৎপর্য এবং  লক্ষ্য উদ্দেশ্য দিবালোকের মতো প্রতিভাত হয়।
ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রতিশব্দ হলো Education. Education শব্দের সাধারণ আভিধানিক অর্থ হলো: শিক্ষাদান ও প্রতিপালন, শিক্ষাদান, শিক্ষ। Educate মানে: to bring up and instruct, to teach, to train; অর্থাৎ প্রতিপালন করা ও শিক্ষিত করিয়া তোলা, শিক্ষা দেওয়া, অভ্যাস করানো। Joseph T. Shipley  তাঁর Dictionary of word Origins-এ লিখেছেন, Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Edex  এবং Ducer-Duc  শব্দগুলো  থেকে। এ শব্দগুলোর শাব্দিক অর্থ হলো, যথাক্রমে বের করা, পথ প্রদর্শন করা। আরেকটু ব্যাপক অর্থে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া এবং সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে দেয়া। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। সক্রেটিসের ভাষায়, শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ। এরিস্টটল বলেন, সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।
এরিস্টোটল বলেছেন, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যে হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।জন ডিউই বলেছেন,  ‌শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্ম উপলদ্ধি। প্লেটোর মত হলো, শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্য অন্তর্ভূক্ত। প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিসের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার। জীন জ্যাক রুশোর মতে, সুঅভ্যাসে গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। Bartrand Russell-এর মন্তব্য হলো: The education system we must aim at producing in the future is one which gives every boy and girl an opportunity for the best that exists.

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতভাবে ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হয়। এতে চুয়ান্নটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৮ শিশু শিক্ষা নিশ্চিত করার দলিল। অনুচ্ছেদ ২৯/১-এ শিক্ষার লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের বিশ্লেষণের করলে দেখা যায়, জাতি সংঘ সাধারণ পরিষদের দৃষ্টিতে শিক্ষার লক্ষ্য হলো : ১. ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ; ২. মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ; ৩. মানসিক শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ; ৪. শারীরিক সামর্থের পরিপূর্ণ বিকাশ; ৫. মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ৬. মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ৭. জাতিসংঘ ঘোষণার বর্ণিত নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ৮. পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ৯. নিজস্ব সাংস্কৃতিক সত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ১০. নিজস্ব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ১১. নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ১২. মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ১৩. অপরাপর সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ; ১৪. সমঝোতা, শান্তি, সহিষ্ণুতা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং সকল মানুষ. নৃ-গোষ্ঠী, জাতীয় ও ধর্মীয় গোষ্ঠ এবং আদিবাসী লোকজনের মধ্যে মৈত্রীর চেতনার আলোকে একটি মুক্ত সমাজে দায়িত্বশীল জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ; ১৫. প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ।

প্রাগৈতিহাসিক কালে শিক্ষা শুরু হয়েছিল বয়স্ক ব্যক্তিদের দ্বারা যুবকদের সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে। প্রাক-শিক্ষিত সমাজ মূলত মৌখিকভাবে এবং অনুকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গল্প-বলার মাধ্যমে জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং দক্ষতা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক দক্ষতা প্রসারিত হতে পারে অনুকরণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা উন্নত করার মধ্যমে। মিশরে মিডল কিংডম এর সময় স্কুল বিদ্যমান ছিল। প্লেটো এথেন্সে একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ছিল ইউরোপের উচ্চতর শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরে আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এথেন্সের বুদ্ধিবৃত্তিক প্যাড হিসাবে এটি প্রাচীন গ্রিসে বিখ্যাত হয়ে ওঠেছিল। সেখানে, আলেকজান্দ্রিয়ার বৃহত্তর গ্রন্থাগারটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের পতনের পর ইউরোপীয় সভ্যতায় সাক্ষরতা এবং সংগঠনের পতন ঘটেছিল।

রোমের পতনের পর, ক্যাথলিক চার্চ পশ্চিম ইউরোপে সাক্ষরতার ও স্কলারশিপের একমাত্র রক্ষাকর্তা হয়ে উঠেছিল। চার্চ ক্যাথিড্রাল স্কুলকে আধুনিক যুগের শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলি শেষ পর্যন্ত মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউরোপের বিভিন্ন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অগ্রদূত হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। উচ্চ মধ্যযুগে সময় চার্টার্স ক্যাথিড্রাল দ্বারা বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী Chartres ক্যাথিড্রাল স্কুল পরিচালিত হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে সুসংহত ছিল, যা তদন্তের স্বাধীনতাকে উত্সাহিত করে, এবং একদল পণ্ডিত ও প্রাকৃতিক দার্শনিকদের সৃষ্টি করেছিল , যেমন, নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের টমাস অ্যাকুইনাস , অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রবার্ট গ্রোসেটেস্ট এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পদ্ধতিগত পদ্ধতির প্রারম্ভিক প্রকাশক, এবং জৈবিক গবেষণার অগ্রদূত সেন্ট অ্যালবার্ট গ্রেট ছিলেন অন্যতম। ১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বলোনি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম এবং প্রাচীনতম অপারেটিং ইউনিভার্সিটি বলে মনে করা হয়।

মধ্যযুগীয় সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক বিজ্ঞান ও গণিত সমৃদ্ধ হয়েছিল ইসলামিক খলিফার অধীনে, যা পশ্চিম আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে পূর্ব সিন্ধু পর্যন্ত এবং দক্ষিণে আলমোরাভিড রাজবংশ ও মালির সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ইউরোপে রেনেসাঁ প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান সভ্যতার বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তদন্ত এবং উপলব্ধির নতুন যুগের সূচনা করেছিল। প্রায় ১৪৫০ সালের দিকে জোহানেস গুটেনবার্গ একটি প্রিন্টিং প্রেস তৈরি করেন, যা সাহিত্যের কাজকে আরও দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের যুগে ইউরোপীয় দর্শন, ধর্ম, শিল্প ও বিজ্ঞান বিষয়ক ধারণাগুলি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। মিশনারি ও পণ্ডিতরা অন্যান্য সভ্যতা থেকে নতুন ধারণা নিয়ে আসছিল – জেসুইট চীন মিশনের সাথে যারা চীন ও ইউরোপের মধ্যে জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইউরোপ থেকে কাজগুলি অনুবাদ করে যেমন চীনের পণ্ডিতদের জন্য ইউক্লিডের এলিমেন্টস অনুবাদ এবং ইউরোপীয় শ্রোতাদের জন্য কনফুসিয়াসের চিন্তা চেতনা কথা বলা যায়। আলোকায়নের যুগের মাধ্যমে ইউরোপ আরও নিরপেক্ষ শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ছিল। বেশিরভাগ দেশে আজ নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সব শিশুদের জন্য পূর্ণ-সময়ের শিক্ষা স্কুলে বা অন্যত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই কারণে বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিস্তার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে মিলিতভাবে, ইউনেস্কো গণনা করে লক্ষ্য করেছে যে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে আরও মানুষ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করবে যা মানব ইতিহাসে বিরল ঘটনা হবে এটি।

মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য দরকার শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে নিজের দেখার চোখ খুলে দিতে হবে, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে হবে। তবেই এই দেশ, এই পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠবে। প্রতিটি মানুষের দুটি ঋণ থাকে-প্রথমটি মায়ের প্রতি ঋণ, দ্বিতীয়টি দেশ মায়ের প্রতি। মা ও দেশ মায়ের প্রতি ঋণ শোধ করার দায়িত্ব যেন সবাই পালন করি। মা ও দেশমাতৃকাকে যেন সবাই প্রাণপণে ভালোবাসি। মুক্তিযুদ্ধে এমনও মানুষ অংশ নিয়েছেন যাঁরা লেখাপড়া জানতেন না, এমনকি অস্ত্র চালানোর মতোও শিক্ষা তাঁদের ছিল না। এর পরও তাঁরা সম্মুখ সমরে গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, আত্ম-উৎসর্গ করেছেন। আমাদের সেই শিক্ষা নিতে হবে, যে শিক্ষা দেশের কাজে লাগে; দশের কাজে লাগে।

(লেখক- গবেষক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কর্মকর্তা)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn