তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুশ্চিন্তা
শেখ মামুনূর রশীদ-
হঠাৎ করেই রাজনীতির ময়দানে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে। সম্প্রতি প্রধান রাজনৈতিক দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা এ নিয়ে কৌতূহলী বক্তব্য দেয়ায় অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন তাহলে কী তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে পর্দার আড়ালে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে (?), বিশেষ করে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের কারণে এ আলোচনার পালে নতুন করে বাতাস লেগেছে। যা নিয়ে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগে।
ষড়যন্ত্রের তথ্য-তালাশও চলছে। তবে শাসক দল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এটি আর ফিরে আসবে না। ইতিমধ্যে আইনি কাঠামোতে এর কবর রচিত হয়েছে। অবশ্য মাঠের বিরোধী দল বিএনপি হিসাব কষতে চায় ভিন্নভাবে। কিছুদিন আগেও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সরব ছিল। কিন্তু এখন ভেতরে ভেতরে ভিন্ন সুর পরিলক্ষিত হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ফর্মুলা থেকে ইউটার্ন নিতে নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ রিভিউ করার চিন্তা করছেন। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। তাই তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তাও দূর হচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে সরকারি দলের অবস্থান জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে জল্পনা-কল্পনার কিছু নেই।’ তিনি মনে করেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এটি একটি অসাংবিধানিক ব্যবস্থা। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার চিরতরে কবর রচিত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে এ ব্যবস্থায় আর ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটেছে। তবে কেউ চাইলে ওই রায়ের বিষয়ে আদালতে রিভিউ আবেদন করতে পারেন। সেই সুযোগ এখনও রয়েছে। যদিও অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবুও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে যে কোনো ব্যক্তির আদালতের ওই রায়ের বিষয়ে রিভিউ আবেদন করার অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত কি সিদ্ধান্ত দেন তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছে- আমার মনে হয় তা সে ফ গুঞ্জন-গুজব। সরকারের শীর্ষ নেতারা অজানা কোনো ভয় বা আতঙ্ক থেকে আদালতকে ইঙ্গিত করেই আগ বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গটি টেনে এনেছেন। এর মধ্য দিয়ে তারা মূলত আদালতকেই প্রধান প্রতিপক্ষ বানাতে চাইছেন।’ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য এবিএম খায়রুল হককে দায়ী করে যুগান্তরকে বলেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে তিনি (এবিএম খায়রুল হক) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি দেশের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করেছেন। দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এই অস্থিতিশীলতার শেষ কোথায় আমরা কেউ জানি না।’ তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দেশের মানুষের আশা-ভরসার জায়গা ছিল। এ ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক দেশের গণতন্ত্রের জন্য সর্বোচ্চ খারাপ নজির স্থাপন করে গেছেন।’
সম্প্রতি নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের বৈরিতার সুযোগে তৃতীয় একটি পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রিভিউ আবেদন করতে পারে- এমন আলোচনাও আছে নানা মহলে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন যুগান্তরকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বাতিল করলেও এখনও সেই রায়ের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করা হয়নি। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘সক্রেটিসের থিওরি নিয়ে করা মামলার রায়ের আড়াইশ’ বছর পর রিভিউ করা হয়েছিল। এমন অনেক নজির আছে। কারণ সংবিধানে ১০৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, আপিল বিভাগের কোনো রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকবে।’
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে রিভিউ করার কথা ভাবছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। তাই তারা যদি এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে- তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত রায়ের রিভিউ করা যাবে না কেন?’
তিনি বলেন, ‘রিভিউ আবেদন গৃহীত হলে এবং আদালত চাইলে ওই ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিতে পারেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় যখন আদালতে প্রকাশ্যে পড়ে শোনান তখন তিনি বলেছিলেন, আরও দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। অথচ এর ১৬ মাস পর যখন তিনি পূর্ণাঙ্গ রায় লিখিতভাবে প্রকাশ করলেন তাতে এ কথাটাই বাদ দিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। একটি পক্ষকে খুশি করতেই তিনি এ কাজটি করেছেন। পরবর্তীকালে এর পুরস্কারও পেয়েছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে। তাই এ বিষয়টি কেউ উল্লেখ করে আদালতে রিভিউ আবেদন করতেই পারেন।’
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি বিদ্যমান ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আর কোনো সুযোগ নেই। তবে রাজনৈতিক রেষারেষি যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তাতে একটি সহমত অবস্থানে আসা জরুরি। সবাইকে একসঙ্গে সে পথ বের করতে হবে। তা না হলে সংকট ক্রমেই আরও ঘনীভূত হবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল। আপিল বিভাগ ২০১১ সালের ১০ মে এ ব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। তবে একই সঙ্গে আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এছাড়া রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয়জন বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে এ রায় দেয়া হয়।
যদিও এর ১৬ মাস পর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গটি বাদ দেয়া হয়। আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আটজন আইনজীবী বক্তব্য দেন। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে তখন মত দেন। তবে ব্যারিস্টার রফিক উল হক এবং ড. এম জহির এ ব্যবস্থা সংস্কারের পক্ষে মত দেন। আরেকজন অ্যামিকাস কিউরি অ্যাডভোকেট আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এরপর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংসদে বিভক্তি ভোটে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন-২০১১ পাসের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। বিভক্তি ভোটে সংবিধান সংশোধন বিলটি পাসের পক্ষে ২৯১ ও বিপক্ষে মাত্র একটি ভোট পড়ে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ফলে আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান ছিল। এখন পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই ৯০ দিনে সংসদ থাকলেও অধিবেশন বসবে না। এ জন্য সংবিধানে একটি নতুন সংশোধনী যুক্ত করা হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের কোনো নির্দেশ দেয়ার সুযোগ রহিত করা হয়।