আওয়ামী লীগ-বিএনপির দূরত্ব বাড়ছেই
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। বিএনপি বলছে, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগের দাবি, বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক এখনও তুঙ্গে। এদিকে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, কাউকে নির্বাচনে নিয়ে আসা সরকারের কাজ নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দলের এমন অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক মেরুকরণ আরো বাড়ছে। তাই বিতর্কে না জড়িয়ে সব পক্ষের উচিত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের পথ খুঁজে বের করা।
বিশ্লেষকদের মতে, গত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় কমিশন আইন অনুযায়ী এবার বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নিবন্ধন রক্ষার বাধ্যবাধকতায় পড়ে বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে আসবে বলে মনে করে সরকারি দল। এ অবস্থায় নিজেদের মতো করেই নির্বাচনের পথে হাঁটছে বিএনপি। তাদের মতে, গত নির্বাচনের মতো আরেকটি নির্বাচন সরকারের জন্য মোটেই ভালো হবে না। এটা সরকারও বোঝে। তাই গতবার বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টা করা হলেও এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপে আছে সরকার। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীও একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছেন।
পর্যালোচায় দেখা যায়, গতবার সরকারি দল চেয়েছিল বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে। কিন্তু এবারের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে হবে সরকারকে। এমন বাধ্যবাধকতা থেকেই ফখরুল এ কথা বলেছেন। তবে কমিশন আইনের ওপর ভর করে সরকারি দলও মনে করছে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে হবে না, বরং দলটি এবার নির্বাচনে আসতে বাধ্য। দলের ভেতরের অবস্থাও নির্বাচনে আসার পক্ষে। এমন ‘প্রাকৃতিক সুযোগ’কে কাজে লাগিয়ে সরকারও বিএনপিকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, এটি দুটি দলের অবস্থানগত বক্তব্য। তিনি বলেন, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে তা থেকেই সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যেতে অনীহা প্রকাশ করছে। যদিও দলটির নেতারা নির্বাচনে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলছেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহের কথা বলছেন। কিন্তু বিএনপিকে সরকার নির্বাচনে নিয়ে যাবে-এমনটা ভাবা কতটুকু ঠিক, তা বিএনপিই বলতে পারে। আমি মনে করি, এ কথা দিয়ে মির্জা ফখরুল নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির কথা বলতে চাইছেন। তবে একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার উপায় খোঁজার দায়িত্ব সরকারের। বিএনপিকেও সেই পরিবেশ তৈরির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে হবে; যাতে সরকার নির্বাচনে নিতে বা পরিবেশ তৈরি করতে বাধ্য হয়।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামছুর রহমান বলেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। আর সরকারও চায় বিএনপিকে রেখেই আরেকবার বিজয়ী হতে। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বাভাবিক চাপে সরকার আছে, এটা ঠিক। তবে তাই বলে বিএনপিকে ডেকে নির্বাচনে আনবে না বা পরিবেশ তৈরি করে দেবে, তা হয় না। রাজনৈতিক কালচার হচ্ছে, বিরোধীদের সবসময় নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের। সেখানে তারা কতটা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে, সেটাই দেখা বিষয়। তবে বিশ্বাসযোগ্য আচরণও তাদের দেখাতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ গতবার বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে কাজ করেছিল। কিন্তু এবারের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেটা আর সরকারি দলের পক্ষে সম্ভব নয়। পরবর্তী পাঁচ বছর ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করে ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করা সম্ভব নয়। তাই ফলটা নিজেদের পক্ষে নিতে চাইলেও বিএনপিকে নির্বাচনে রেখেই তাদের নিতে হবে। তাছাড়া নির্বাচনে না গেলেও বিএনপি বসে থাকবে না। নির্বাচন প্রতিহতের মতো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে অনেক রক্ত ঝরতে পারে। একটা খারাপ কাজ বারবার করা রাষ্ট্রের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। এটা সরকারকে বুঝতে হবে।
যদিও মির্জা ফখরুলের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওরায়দুল কাদের বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি যতই অভিযোগ দিক আর নালিশের যত ভাঙা রেকর্ড বাজাক; নিবন্ধন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে আসবে। সরকারের দয়ায় তারা রাজনীতি করে না। রাজনীতি করে তাদের আদর্শে। কাজেই নির্বাচনে আসা তাদের অধিকার। সরকার কেন তাদেরকে নির্বাচনে নিয়ে আসবে? কাদের বলেন, গত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তারা যে ভুল করেছে। সেই ভুলের চোরাবালিতে আটকে গেছে বিএনপি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার স্বার্থে তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচন করতে হবে। পরপর দুই নির্বাচন না করলে বিএনপির নিবন্ধন চলে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে।
সরকারি দলের এমন ভাবনার জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে কী করে নির্বাচনে আনবেন, সেই চেষ্টা করুন। বিএনপি নির্বাচনে না এলে নিবন্ধন বাতিল হবে বলে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা নির্বাচন চাই। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার কথা আমরা কখনো চিন্তা করি না। আপনি ক্ষমতায় বসে থাকবেন, কল-কব্জা নাড়বেন, ইলেকশন ম্যানিপুলেটেড করবেন, আর আমাকে বলবেন তুমি নির্বাচনে যাও, সেটি হবে না। আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। অন্যথায় এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের মহাসচিব যে কথা বলেছেন তার সারমর্ম হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থার বিষয়ে। সরকার বারবার একই পথে হাঁটবে, তা আর হবে না। আমরাও জানি, সরকার থেকে দাবি আদায় করতে হবে। আর সামনের দিনে বিএনপি সেটা করবে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো আরেকটি গোঁজামিলের পথে সরকার হাঁটবে-এটা দেশবাসী মেনে নেবে না। বিএনপি দাবি আদায় করেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।’