বাংলাদেশী কিশোরদের আমেরিকায় যাবার লোমহর্ষক কাহিনী
অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাংলাদেশীরাও স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাচ্ছে দালালকে মোটা অর্থ দিয়ে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে মেক্সিকো হয়ে দুর্গম সীমান্ত পথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় প্রায় সকলেই ধরা দিচ্ছে। আর যাদের দুর্ভাগ্য, তারা ভয়ংকর প্রাণীর পেটে কিংবা পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এমসি করুণ পরিণতির শিকার হয় বাংলাদেশি আরমান শেখ। পানামা খাল পাড়ি দেয়ার সময় সে ভেসে যায় ¯্রােতে। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর তার অর্ধ গলিত লাশ উদ্ধার করে সীমান্ত পুলিশ। এরপর কফিনে বন্দি হয় আরমান ও তার পরিবারের সুখ-স্বপ্ন। আরমানের মৃত্যু সংবাদ গোপন থাকেনি। তারপরও এ পথে পা বাড়া্েনা বন্ধ হয়নি। যুবক-যুবতীর পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীরাও প্রিয় মাতৃভ’মি ছাড়ছে দালালের খপ্পরে পড়ে। মাথাপিছু ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা দালালকে প্রদানের পাশাপাশি পকেট খরচ বাবদ আরো কয়েক হাজার ডলার লাগছে জীবন-স্বপ্নের এ জার্নিতে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকলেই কিংবা ইমিগ্রেশন পুলিশে ধরা দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেই যে তা মঞ্জুর হয়, তেমন কোনই গ্যারান্টি নেই। অধিকন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিই হচ্ছে, ইন্সপেকশন ছাড়া চোরাই পথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারীরা কোনভাবেই বৈধতা পাবে না। ইতিপূর্বে মেক্সিকো অথবা কানাডা হয়ে কর্তৃপক্ষের দষ্টি এড়িয়ে ঢুকেছিলেন, এমন বাংলাদেশীদের মধ্যে যাদের এসাইলাম এখনো মঞ্জুর হয়নি, তারা রয়েছেন মহাবিপাকে। গত দু’মাসে এমন অন্তত: ২১ বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করে ডিটেনশেন সেন্টারে নেয়া হয়েছে। তারা অপেক্ষায় রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের। অপরদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে ১৮ বছরের কম বয়েসী যারা সীমান্ত অতিক্রমের সময় ধরা পড়েছে, তাদেরকে সীমান্ত এলাকায় ‘ইন্টারন্যাশনাল চিল্ড্রেন রিসিপশন সেন্টার’-এ রাখা হয়েছে। তারা কর্তৃপক্ষের নজরে রয়েছে। এরমধ্যে যাদের স্বজন রয়েছে, তারা যদি দায়িত্ব নেন, তাহলে ঐ কিশোর-কিশোরীকে প্যারলে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। এমন কিশোর-কিশোরীরা ইমিগ্রেশনে দরখাস্ত করেছে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে। তারা যুক্তি দেখিয়েছে যে, তাদের বাবা অথবা বড় ভাই বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের রোষানলে পড়েছেন। বাবা-ভাইয়ের কারণে তারাও নাকি নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে পড়েছিল বলেই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। এখন যদি তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাদের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়বে। যদিও আবেদনকারিদের কেউই কোন প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি যে, তাদের বাবা অথবা বড় ভাইয়েরা সরকারের রোষানলে রয়েছেন কিংবা গ্রেফতার হয়েছিলেন বা জেলে নেয়া হয়েছে। এতদসত্বেও ইমিগ্রেশন বিভাগ তাদের বয়স বিবেচনায় রেখে প্যারলে মুক্তি দিচ্ছে এবং ১৮ বছর পূর্ণ হবার পরই তাদেরকে ইমিগ্রেশন কোর্টে হাজিরা দিতে হবে। সে সময় তারা যদি প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সাবমিট করতে পারে তাহলে ভাগ্য প্রসন্ন হবে বলে ইমিগ্রেশন এটর্নীরা জানান।
এমন অবস্থায় থাকা দুই তরুণের সাথে কথা হয় এ সংবাদদাতার। এদের একজন আব্দুল্লাহ আল বাকি। নোয়াখালির সোনাইমুড়ি উপজেলার আমিস্বাপাড়ার সন্তান বাকি গত বছরের ১ অক্টোবর ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করে। ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রাজিলেই ছিল। ২৭ অক্টোবর পেরু যাবার পথে ব্রাজিলের সৈন্যরা গ্রেফতার করে। এ প্রসঙ্গে বাকি বলে, ‘সৈন্যরা জানে না ইংলিশ। ধরা পড়া ৫ জনই বাঙালি ছিলাম। আমরাও জানি না ওদের ভাষা। এমন অবস্থায় পড়ি মাইনক্যার চিপায়।’ ‘আমাদের কাছে পেরু যাবার ভিসা ছিল না বলে গ্রেফতার করে। এ অবস্থায় আমাদের যারা গাইড করছিল, তাদের একজন (দালাল) সৈন্যদের কিছু টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। পাড়ি দেই পেরুতে। এরপর ২৩ ঘন্টার বাস জার্নি। পৌঁছি লিমায় এক দালালের বাসায়। তার বাড়ি সিলেটে। নাম কার্লোস। সেখান থেকে প্রবেশ করি গুয়াতেমালায়। দালালের সাথেই মেক্সিকো ঢুকতে সক্ষম হই। সেখানে ‘সাদেকের হোটেল’ আছে। দালালেরা সেটি পরিচালনা করে। মেক্সিকোর ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাত করে ২০ দিন অবস্থানের কার্ড সংগ্রহ করি। এই ২০ দিনের মধ্যেই মেক্সিকো ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে হয়’-বলে বাকি। সীমান্তের নিকটেই মেক্সিক্যালি এয়ারপোর্টে যাই এবং সীমান্ত রক্ষীদের কাছে ধরা দেয়ার ফাঁদ পাতি। এক পর্যায়ে সফলও হই। যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে ঢুকার পরই ইমিগ্রেশন এজেন্টরা ধরে ফেলে। সাথে সাথে আমি এসাইলাম প্রার্থনা করি। কিন্তু আমার বয়স ১৮ বছর না হওয়ায় টেক্সাস থেকে সোজা শিকাগোতে চিল্ড্রেন রিসিপশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। ঐ সেন্টারে পৌঁছার পরই নিউইয়র্কে এক আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি জুনের ৪ তারিখে আমাকে প্যারলে মুক্ত করেছেন। অর্থাৎ বাড়ি ছাড়ার ৮ মাসের মাথায় নিউইয়র্কে মুক্ত জীবন ফিরে পেয়েছি। বলেছে বাকি। আসছে নভেম্বরে বাকির বয়স ১৮ বছর হবে। এরইমধ্যে বাকি বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, শিকাগোর সেই চিল্ড্রেন সেন্টারের লিডার হতেও পেরেছিল। সেখানে মোট ১৫ বাংলাদেশীর সাক্ষাত পায় সে। সকলেরই বাড়ি সিলেট অথবা নোয়াখালীর। বাকি বলেছে পানামা খালের পানির ¯্রােতে ভেসে যাওয়া আরমানও তার সাথেই ছিল। আরমান সাঁতার জানতো না বলে এমন মৃত্যুর শিকার হয়। তাই জীবনের ঝুঁকি গ্রহণকারিদের অবশ্যই সাঁতার জানা থাকা উচিত বলে উল্লেখ করেছে বাকি। বাকির সাথে ছিল কাউসার নামে আরেক কিশোর। তাকে শিকাগোর চিল্ড্রেন সেন্টার থেকে মুক্ত করে নিউইয়র্কে আনা হয়েছে গত ১৭ আগস্ট। কাউসার জানায়, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর রাতে ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছিলাম। দালালকে দেয়া হয় ১৩ লাখ টাকা। তবে পথিমধ্যে বিভিন্ন দেশেও ঐ দালালের এজেন্টদের নগদ অর্থ দিতে হয়েছে। পকেট খরচও লেগেছে বেশ কয়েক শত ডলার। কাউসার বলেছে, দালালরা কখনোই খারাপ ব্যবহার করেনি কিংবা পথিমধ্যে কোন বিপদের সময়েও কেটে পড়েনি। কাউসার জানায়, আমি ব্রাজিলে আড়াই মাস কাজ করেছি একটি সুপার মার্কেটে। সেখানে ফেঞ্চুগঞ্জের ভাটেররা লোক রয়েছেন। দালালের সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে। আমরা ১১ জন ছিলাম এক গ্রুপে। যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকার পরেই আত্মসমর্পন করি। ইমিগ্রেশন এজেন্টরা প্রথমেই নাম জানতে চায়। পাসপোর্ট দেখতে চায়। বয়স জানার পরই আমার মত কম বয়েসীদের আলাদা করে। আর কোন উচ্চবাচ্য করেনি।
অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ব্যাপারে সীমান্ত রক্ষীসহ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের এই সহনীয় ভাবকে পুঁজি করে দালালরা কিশোর-কিশোরীদের টার্গেট করছে বলে জানা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে প্যারলে মুক্তি পেয়ে নিউইয়র্কে আসা এক বাংলাদেশী (নাম গোপন রাখার শর্তে) এ সংবাদদাতাকে বলেন, মেক্সিকোতে দালালদের আস্থানায় এখনও শতাধিক বাংলাদেশী কিশোর অপেক্ষা করছে টেক্সাসে প্রবেশের। এদের অধিকাংশই নোয়াখালী ও সিলেটের। কিশোরদের সাথে যুবকও রয়েছেন বেশ কয়েক ডজন। তারা মেক্সিকোর রিফ্যুজি কার্ড কয়েক দফা (২০ দিন মেয়াদ থাকে) নবায়ন করেছেন। সুযোগ পেলেই সীমান্ত অতিক্রম করে কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন।
গত এক বছরে মেক্সিকো হয়ে দুর্গম পথে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকার সময় নিহতদের মধ্যে ২১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশী আরমান তাদেরই একজন।
অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার এক দালাল আরমানের পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেয় এবং আরমানের এক আত্মীয়ও ছিলেন ঐ গ্রুপে। পরিবারের তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আরমান শেখ সবার ছোট। প্রায় ২৫ লাখ টাকা খরচ করে আরমানকে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। প্রায় ৬ মাস আগে আরমানকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে ওমানে নেয়া হয়। সেখান থেকে আফ্রিকায়। পরে আমেরিকায় আনার জন্য একবার বিমানের টিকিট কাটানো হয়। কিন্তু সেখানকার বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে ফেরত পাঠায় আফ্রিকায়।
আরমানের সঙ্গে সর্বশেষ গত জুন মাসের ২৬ তারিখ কথা হয়। এ সময় আরমান তার আত্মীয়দের ফোনে জানায় যে, সে মেক্সিকোর একটি নদীর পাড়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নদী পাড়ি দিবে। তার সঙ্গে আরো ৪ জন নদী পাড়ি দেয়ার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর কয়েকদিন জেলে থাকতে হবে। ১০-১২ দিন পর আবার ফোন দেবে।
আরমানের বাবা এনামুল হকও আমেরিকায় ছিলেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে যান। অনেক টাকা ঋণ করে আরমানকে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে নিষেধ করা হয়েছিলো। কিন্তু সে জেদ করাতে তাকে পাঠানো হয়।
আরমানের ভগ্নিপতি শাহেদ কামাল সুজন প্যারলে মুক্তি পেয়ে এখন নিউইয়র্কে বাস করছেন। জানা গেছে, এই সুজন এলাকার বহু মানুষকে ঠকিয়ে মোটা অর্থ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন।
এ সংবাদ লেখার সময় টেক্সাসের এল পাসো ডিটেনশন সেন্টার থেকে ফোন করেন পারভেজ আব্দুল্লাহ নামক এক বাংলাদেশী। দুই বছর ৯ মাস যাবত সেখানে রয়েছেন তিনি। পাসপোর্ট না থাকায় ইমিগ্রেশন বিভাগ তাকে বহিষ্কারও করতে পারছে না। মৌলভীবাজারের সন্তান পারভেজ ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন অবিলম্বে তার ট্র্যাভেল ডক্যুমেন্ট ইস্যুর জন্যে।
এদিকে, ‘সাউথ এশিয়ান ফান্ড ফর এডুকেশন, স্কলারশিপ এ্যান্ড ট্রেনিং’ নামক একটি সংস্থার পক্ষ থেকে মাজেদা এ উদ্দিন ইউএস সিনেটর চাক শ্যুমার, সিনেটর জিলিব্র্যান্ড, কংগ্রেসম্যান যোসেফ ক্রাউলিকে প্রদত্ত এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশীদের অযথা হয়রানি বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন। কোন ধরনের অপরাধে লিপ্ত না থাকা সত্বেও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ইমিগ্রেশন কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে বেশ কয়েক বাংলাদেশী সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন বলে ঐ স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এদেরকে নিউজার্সি ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার জন্যে। এভাবেই অসহায় ও নিরপরাধরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার দাবি করছেন যে, নিরপরাধ অবৈধ ইমিগ্র্যান্টরা হয়রানির শিকার হচ্ছে না।