জগন্নাথপুরে নির্বাচনকে সামনে রেখে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ
সানোয়ার হাসান সুনু ::
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জগন্নাথপুরে বিবদমান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ‘কোন্দল’ আবারো প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। দলের দুটি বলয়ের নেতা স্থানীয় সংসদ সদস্য অর্থপরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম.এ মান্নান ও অন্য বলয়ের নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামীলীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ তনয় আজিজুস সামাদ আজাদ ডন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের নিয়ে পৃথকভাবে গণসংযোগ ও সভা সমাবেশ করে যাচ্ছেন। দুই নেতাই ক্ষমতাশীন দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। চষে বেড়াচ্ছেন জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা। প্রায় প্রতিদিনেই নিজ নিজ কর্মী সমর্থকদের নিয়েই এলাকাবাসীর সাথে বৈঠক করছেন। সময়ক্ষন ঠিক না হলেও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের অন্তর্ভূক্ত জগন্নাথপুর ও দক্ষিন সুনামগঞ্জে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কোন্দল গ্রæপিং এখন আবারও প্রকাশ্যে রূপলাভ করছে। মনোনয়ন নিয়ে শুধু আওয়ামীলীগ নয় বিরোধীদল বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হিসেব নিকেষ শুরু হয়ে গেছে।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামীলীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে বর্তমান অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও আওয়ামীলীগ ঘরানার প্রার্থী এ নির্বাচনী এলাকার চার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ তনয় আজিজুস সামাদ ডন ফুটবল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে কাজ চালিয়ে গেলেও পরাজিত প্রার্থী আজিজুস সামাদ ডন অনুসারীরা মাঠ ছেড়ে নিরব হয়ে যান। বিগত পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে আজিজুস সামাদ ডন অনুসারীরা আবারও জগন্নাথপুরের রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় হতে শুরু করেন। আগস্ট মাসে ডন অনুসারীরা উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে পৃথকভাবে তৃণমুল আওয়ামীলীগের ব্যানারে কর্মসূচী পালন করেন। অপরদিকে আওয়ামীলীগের মুলধারা স্থানীয় সংসদ সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান অনুসারীরাও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
দলের নেতাকর্মীরা জানান, উপজেলা আওয়ামীলীগের কার্যকরী কমিটির সহ-সভাপতি পৌর মেয়র আব্দুল মনাফ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন মাস্টার, সাংগঠনিক সম্পাদক জয়দ্বীপ সূত্রধর বীরেন্দ্রসহ বেশ কয়েকজন পদদারী আজিজুস সামাদ ডন বলয়ে থাকলেও অধিকাংশ নেতাকর্মীরা স্থানীয় সংসদ সদস্য এম এ মান্নানের রাজনৈতিক অনুসারী স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা সিদ্দিক আহমদের নেতৃত্বে রয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের দ্বিধাবিভক্তি ও বিরোধের প্রভাব পৌরসভার পাশাপাশি উপজেলার আটটি ইউনিয়ন লেগেছে। গত ৩১ আগষ্ট আজিজুস সামাদ ডন অনুসারীরা ব্যাপক শোডাউনের মাধ্যমে শোকবন্ধন কর্মসূচী পালন করেন। অচিরেই ঈদ পুনর্মিলনী পালন করবেন বলে তাদের প্রচারনা চলছে।
আজিজুস সামাদ ডন অনুসারী হিসেবে পরিচিত উপজেলা আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক জয়দ্বীপ সূত্রধর বীরেন্দ্র বলেন, রাজনৈতিক মাঠে আমরা সব সময় সক্রিয় আছি। তৃণমুলের ব্যনারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নে আজিজুস সামাদ ডনের নেতৃত্বে দলীয় কার্যক্রম চলছে। কিন্তুু দুঃখের বিষয় ইতিমধ্যে আমাদের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী রাজনৈতিক হয়রানীর শিকার হয়ে জেল কাটতে হয়েছে। সম্প্রতি আমাদের সক্রিয় কর্মী সিদ্দিকুর রহমানকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় জেলে যেতে হয়েছে। উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রিজু বলেন, আমরা কোন প্রতিহিংসার রাজনীতি করিনা। আমরা বর্তমান সরকারের উন্নয়নমুলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্থানীয় সংসদ সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ উপজেলার আওয়ামীলীগ রাজনীতির অভিভাবক সিদ্দিক আহমদের পরামর্শে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
অপরদিকে বিএনপি এবার ধানের শীষ নিয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে মরিয়া। দলের যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমদ, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এম.এ মালেক খান ও জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি লে. কর্ণেল অব. সৈয়দ আলী আহমদ দলের মনোনয়ন পাওয়ার লক্ষে কেন্দ্রে জোর লবিং ও প্রচারনায় রয়েছেন।অপরদিকে জোটের অন্যতম শরিক দল জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী এডভোকেট মাঠে রয়েছেন। তিনিও জোটের প্রার্থী হিসাবে প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় জোটের মধ্যে এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, এবার ধানের শীষ নিয়ে যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমদ (যিনি তারেক রহমানের ঘনিষ্টজন) নির্বাচন করবেন। সে ক্ষেত্রে জোটের শরিক জমিয়ত নেতা সাবেক এমপি মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীক যদি না পান তবে খেজুর গাছ প্রতীকে নির্বাচন করবেন।
উল্লেখ্য জগন্নাথপুর-দক্ষিন সুনামগঞ্জ নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-৩ নির্বাচনী এলাকার দীর্ঘদিনের সংসদ ছিলেন জাতীয় নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। ২০০৪ সালে বার্ধ্যকজনিত কারণে সামাদ আজাদের মৃত্যু হলে এ আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পান পাতা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন সাবেক যুগ্ম সচিব এম এ মান্নান। নির্বাচনে চারদলীয় জোট প্রার্থী জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধূরী ধানের শীষ প্রতীকে ৪২ হাজার ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মান্নান ৩৮ হাজার ভোট পেয়ে একটা অবস্থান তৈরী করে নেন। এসময় আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে যুবলীগ নেতা নজরুল ইসলামও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন।
উপ-নির্বাচনে পরাজয়ের পর এম এ মান্নান আওয়ামীলীগ সভানেত্রীর হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আওয়ামীলীগে যোগ দেন। যোগদানের পর থেকে তিনি নির্বাচনী এলাকায় গনসংযোগ শুরু করেন। বিগত ২০০৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে ভোটাররার তাকে একজন বিজ্ঞ আমলা হিসেবে তারকা প্রার্থী মনে করে বিপুল ভোটে জয়ী করেন। পরবর্তীতে তিনি আবারও দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। দলীয় মনোনয়ন পেলে আবারও তিনি নির্বাচন করবেন বলে তাঁর ঘনিষ্টজনরা জানিয়েছেন। অপরদিকে মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে মাঠে কাজ করছেন আজিজুস সামাদ ডন। তবে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি নেতাকর্মীদের ভাবিয়ে তুলছে। অপরদিকে আওয়ামীলীগের সাথে মহাজোটে না থাকলে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্য জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি সাজ্জাদুর রহমান ভূঁইয়া, যুগ্মসম্পাদক জুবায়ের আহমদ হামজা ও যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য নজরুল ইসলাম নির্বাচন করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। সময় যত ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক উত্তাপ ততই বাড়ছে।