সিলেটের সমৃদ্ধ লোকভান্ডারের এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে মরমি গান। এ অঞ্চলের সাধকগণ তাঁদের অন্তরের নির্যাস সুরের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন মরমি গানে। জীবন-জগৎ, দেহ-আত্মা-পরমাত্মা, সৃষ্টিতত্ত্ব এমন বিষয়ভিত্তিক হাজারো ভাবনার প্রকাশ রয়েছে তাঁদের রচিত মরমি গানে। মানুষের মনে ইহকাল-পরকাল-মানব সাধনা-মুর্শিদভজন-সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গানগুলো ভাবনা আর সাধনার খোরাক জোগায়। গবেষকদের মতে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ক্ষেত্র তৈরি করেছে মরমি সাহিত্য। আর মরমি সাহিত্যের বলিষ্ঠ অংশ মরমি গান। মরমি সাধনা, ভাবনা মানুষের অন্তর্জগৎকে আলোকিত করে। মরমি সাধকেরা অহর্নিশ মানব ও স্রষ্টার সম্পর্ক, সৃষ্টিজগৎ, ষড়্‌রিপুর কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্তি, মানব জনমের আদিতত্ত্ব, মানব জনমের কৃতকর্ম, মৃত্যুর পরের বিষয়, কেন এই সৃষ্টি, কোথায় এর সমাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে মগ্ন চিত্তে দিনাতিপাত করেছেন এবং এই ভাবনাগুলোর বীজ থেকেই জন্ম হয়েছে মরমি গান।
ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মতে, ‘সিলেট লোকসংস্কৃতির চারণভূমি এবং লোকসংস্কৃতির অফুরন্ত ভান্ডার—যার বুকে ধারণ করে এ ভূখণ্ড—মননশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতর অবদান রেখে চলেছে যুগ যুগ ধরে।’ ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত সিলেটের মরমি সাধক গ্রন্থে সৈয়দ মোস্তফা কামাল অসংখ্য মরমি সাধকের নাম ও আবাসস্থল উল্লেখ করেন। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুমনকুমার দাশ তাঁর বাংলাদেশের বাউল-ফকির: পরিচিতি ও গান বইয়েও সিলেট অঞ্চলের প্রথিতযশা মরমি সাধকদের জীবন ও গান নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। সিলেট অঞ্চলে মানুষের মানবিক ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মরমি সাধকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিষয়টি প্রত্যেক গবেষকই উপস্থাপন করেছেন। সতেরো শতকের সৈয়দ শাহনুর, দীন ভবানন্দ সিলেট অঞ্চলেরই বিশিষ্ট গীতিকার। ‘শুয়া উড়িল, উড়িল, উড়িল রে’ গানের গীতিকার শিতালং শাহ, ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’ গানের গীতিকার শেখ ভানু সিলেট অঞ্চলেরই সাধকপুরুষ। এ ছাড়া এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সৈয়দ আবদুল লতিফ, আরকুম শাহ, দীনহীন, ইব্রাহিম তশনা, মৌলানা ইয়াছিন শাহ, কালা শাহ, আছিম শাহ, দেওয়ান একলিমুর রাজা, কামাল উদ্দিন, কফিলউদ্দিন সরকার প্রমুখ গীতিকার।
দুই
সিলেট অঞ্চলের যেসব মরমি সাধকের গান দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করে নিয়েছে এর মধ্যে রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, গিয়াসউদ্দীন আহমদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। রাধারমণ ১৮৩৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ধামাইল গানের প্রবর্তক হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রায় তিন হাজার গান তিনি রচনা করেছেন বলে গবেষকেরা জানিয়েছেন। ‘বাউল কবি রাধারমণ’ নামে একটি সংকলন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়, যেখানে তাঁর ৮৯৮টি গান সংযোজিত হয়েছে। এ ছাড়া চৌধুরী গোলাম আকবর সংগৃহীত গ্রন্থ রাধারমণ সংগীত, নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত রাধারমণ গীতিমালা এবং সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত অগ্রন্থিত রাধারমণ বইগুলো রাধারমণ-গবেষণার এক অনন্য নজির। এর বাইরে গুরুসদয় দত্ত, নির্মলেন্দু ভৌমিক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ মুর্তাজা আলীসহ অনেকেই রাধারমণের গান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন।
হাসন রাজার গানের প্রশংসা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও করেছেন। ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী হাছন রাজা পরিণত বয়সে ভাব রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে গান রচনায় মগ্ন হন। ‘বাউলা কে বানাইল রে’, ‘মাটিরো পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। হাসন রাজা ৬ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে শাহ আবদুল করিমের গান। দেশ-বিদেশে শ্রোতাদের মধ্যে তাঁর গানের আবেদন খুব বেশি। তিনি ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামে জন্ম নেন। একজন রাখাল বালক ছিলেন, কিন্তু নিজ প্রচেষ্টায় তিনি তাঁর গানকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন, এ কারণেই মানুষজন এখন তাঁকে ভালোবেসে ‘বাউলসম্রাট’ অভিধায় চিহ্নিত করেন। তিনি যেমন একাধারে বাউল সাধক, তেমনি একজন সার্থক গণগীতিকারও ছিলেন। পাঁচ শতাধিক গান তিনি রচনা করেছেন। তাঁর গান এখন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। মালজোড়া গানেরও তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট শিল্পী।

সিলেটের আরেক মরমি সাধক দুর্বিন শাহ। ছাতকের নোয়ারাই গ্রামে তারামনি টিলায় (বর্তমান নাম দুর্বিন টিলা) ১৯২০ সালে দুর্বিন শাহের জন্ম। রাজনীতি ও সমাজসচেতন দুর্বিন শাহ মালজোড়া গান করতেন এবং গান লিখতেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন গায়ক হিসেবে দুর্বিন শাহকে বলা হতো ‘জ্ঞানের সাগর’। ‘নামাজ আমার হইল না আদায়’, ‘নির্জন যমুনার কূলে বসিয়া কদম্ব তলে’, ‘জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারই চরণে রে’সহ তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে। তিনি ১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। সুমনকুমার দাশের সম্পাদনায় তাঁর গানের সংকলন ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’ প্রকাশিত হয়েছে। মরমিসাধক গিয়াসউদ্দিন আহমদের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৪ আগস্ট সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার শিবনগর গ্রামে। প্রায় এক হাজার গান তিনি রচনা করেছিলেন। ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়রে যাদু ধন’, ‘সিলেট পরথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়াছে’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
তিন
সিলেটের মরমি গানের বিশাল ভান্ডার, যার থেকে খুব স্বল্পপরিসরে কিছু সাধক আর তাঁদের গান উপযুক্ত রচনায় তুলে ধরা হলো। আরও অনেক সাধক রয়েছেন, যাঁদের গান এ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে যথাযথ সংরক্ষণ এবং সংকলিত করে প্রকাশিত হয়নি। রত্নগর্ভা পুণ্যভূমি সিলেটে সাধক মহাজনেরা তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে তৈরি করেছেন এক অমৃত ভান্ডার—যার যার সুরমূর্ছনায় আপ্লুত সবাই। হাওর-বাঁওড়-টিলাঘেরা এই অঞ্চলে ভাবুক হৃদয়ের আকুলতায় বর্ণ-শব্দ-সুর-তাল-লয়ের মিতালি দিয়ে সত্য ও সুন্দরের বন্দনা করতে অসংখ্য সাধক এখানে জন্ম নিয়েছেন। এ রচনার বাইরেও মরমি গানের উর্বর চারণভূমি সিলেট অঞ্চলের আরও অনেক মহাজনের নাম ও কর্ম অনুচ্চারিত রয়ে গেল। এর মধ্যে বাউলসাধক কারি আমিরউদ্দিন, মো. শফিকুন্নুর, রোহী ঠাকুর, অন্নদা রঞ্জন দাশ, ফকির সমছুল, মকদ্দস আলম উদাসী, আবদুর রহমান, শিল্পী রামকানাই দাশ, সুষমা দাশ, চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ উল্লেখযোগ্য। তবে মরমি ভাবধারার এসব সাধক ও শিল্পীর গান সঠিক ও যথাযথভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলেই এই অঞ্চলের সৃষ্টি বিশ্বময় আরও উজ্জ্বল রূপ পাবে।
লেখক: নাট্যকার ও উপস্থাপক; আমেরিকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সিলেট উৎসবে সিলেট থেকে প্রতিনিধিত্বশীল সংস্কৃতি সংগঠক।কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn