বেদনাবৃত শালিক কবি হেলাল হাফিজ
হাসান হামিদ-
কবি হেলাল হাফিজের সাথে আমার জানাশোনা দীর্ঘদিনের। বিয়ের পর থেকে আমার স্ত্রীকে তিনি মেয়ে বলে ডাকেন এবং আমি ফোন করলে, দেখা করতে গেলে আপ্লুত হন, বরাবরই জামাই আদর পাই। কথা বলতে বলতে আমরা সন্ধ্যা নামিয়েছি কতোদিন। আমার লেখা অজস্র কবিতা তিনি পাঠ করেছেন; বলতে লজ্জা লাগছে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছেন, প্রশংসা ও উপদেশ দিয়েছেন। আজ তাঁর জন্মদিন। শুভেচ্ছা জানাবার পাশাপাশি তাঁর কবিতা নিয়ে কিছু লিখব।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশে একটি কবিতার বই লিখে যিনি ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন, তিনি হেলাল হাফিজ। তিনি ষাটের দশকের দ্বিতীয় ভাগে কবিতার সাথে ঘর-গেরস্থালি শুরু করেন। জীবন খরচ করে লেখা তাঁর কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ নামের বইটি বদলে দেয় বইপাড়ার সব হিসাব। কবিতা সৃষ্টির মর্মযাতনা বোদলেয়ার, ইয়েটস, এলিয়ট, জীবনানন্দ হয়ে বিনয় মজুমদার পাঠে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি একই যাতনা তীব্রতর হয়ে ওঠে হেলাল হাফিজের কবিতায়। হেলাল হাফিজের কবিতার বিষয় ব্যক্তিপ্রেম ও দেশপ্রেম। আপাতদৃষ্টিতে তার কবিতা সহজ-সরল মনে হলেও, এর সরল সৌন্দর্য সৃষ্টির নেপথ্যে আছে সচেতনভাবে অলঙ্কার প্রয়োগের ভূমিকা। পাঠকের কাছে এই কবিতা মহার্ঘ্য হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় কারণ এর ছন্দ ও ধ্বনি মাধুর্য।
হেলাল হাফিজ ছন্দ সচেতন কবি। ভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষরণ পরবর্তী স্বাধীনতার দাবিতে ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের উন্মাতাল সময়ই হেলাল হাফিজকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে তার শ্রেষ্ট কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। হেলাল হাফিজের কবিতা ক্ষরিত সময়ের গভীরে জন্ম নেওয়া এক আলোকপর্বমুখী বোধ। যা সমকালীন পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় স্বতন্ত্র, উজ্জ্বল।
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’
(নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়/ যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজের এ কবিতাটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। মিছিলে, স্লোগানে সর্বাধিক উচ্চারিত হওয়ায় কবিতাটি সময়ের জীবন্ত দলিল হিসেবেও বিবেচিত হয়ে আসছে।
একজন প্রকৃত কবির শক্তি তার সৌন্দর্য সচেতনতা ও কল্পনার সুসংহত জগতকে ঘিরে বেড়ে ওঠে। কবির উদ্দেশ্য হচ্ছে মনোবিশ্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনভূতি সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে নন্দনতাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করা। সময়ের অনুভবে ভর করে চিরকালের প্রকাশাকাঙ্ক্ষায় সে কবিতা প্রকৃত কবিতার মর্যাদা পায়। শার্ল বোদলেয়ার বলেন, I have Sound a definition of the Beautiful. It is something intense and sad, Something a little vague, leaving scope for conjecture.’ অর্থাৎ—‘আমি আমার সৌন্দর্যের সংজ্ঞা পেয়েছি, আমার নিজের সৌন্দর্যের ধারণা। এ হচ্ছে এমন একটা কিছু যা তীব্র ও বিষণ্ন, একটা কিছু যা একটু অস্পষ্ট, সুতরাং আভাসে ও অনুমানে যা বুঝে নেওয়ার বিষয়।’ বোদলেয়ারের এ উক্তি প্রণিধানযোগ্য এ কারণে যে, একজন কবি নিজেকে চেনার দিব্যক্ষমতা দিয়েই কবিতার সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন।
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ গদ্যছন্দে লেখা হলেও এর পর্ববিন্যাসে অক্ষরবৃত্তের ছাপ পাওয়া যায়। কিছু কিছু শব্দ বাদ দিলে একে মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা বলেই মনে হয়।
এরকম আরো কিছু কবিতার উদাহরণ দেয়া যাক :
‘মানব জন্মের নামে/হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে/আমি যদি মিছিলে না যাই
উত্তর পুরুষে ভীরু/কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে/এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।
[দুঃসময়ে আমার যৌবন]
গদ্যছন্দ অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরই বিবর্তিত রূপ। অক্ষরবৃত্ত আবৃত্তিকালে স্বাভাবিক উচ্চারণের ধ্বনি প্রাধান্য লাভ করে অর্থাৎ এ ছন্দের দোলা স্বাভাবিক কথা বলার মতোই। তাই গদ্যছন্দে লেখা বিবৃতিমূলক কবিতায় তিনি অক্ষরবৃত্ত ছন্দের পোশাক পরিয়েছেন। তবে তিনি শুধু গদ্যছন্দে অক্ষরবৃত্তের দোলা তৈরি করেননি, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচনা করেছেন তাঁর কবিতার শরীর।
‘জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল
কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।’
[কোমল কংক্রিট]
দুই লাইনে সম্পূর্ণ এই কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত পয়ারে রচিত। হেলাল হাফিজ আয়তনে ছোট ছোট বেশকিছু কবিতা রচনা করেছেন। যে ঊন কবিতাগুলো বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর গভীরতা ধারণ করেছে। নিখুঁত ছন্দের গাঁথুনি থাকায় পাঠকের কাছে তা আরো বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে। ১৯৮০ সালে লেখা তাঁর একটি জনপ্রিয় ঊন কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যাক, যা মানুষের মুখে মুখে তো অবশ্যই, এখনো দেয়ালে কিংবা টি-শার্টে সদম্ভে নিজের জ্বলজ্বলে উপস্থিতি জানান দেয়-
‘নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না!’
[অশ্লীল সভ্যতা]
দুই পঙ্ক্তিতে বিভাজ্য এই কবিতার প্রথম লাইনে ৮ মাত্রা ও দ্বিতীয় লাইনে ৬ মাত্রা রয়েছে। ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত পয়ারকে ভেঙে কবি দুই লাইনে বিন্যস্ত করেছেন। কিন্তু পাঠকালে ঠিকই লাইন দুটো এক হয়ে পয়ারের ঢেউ তোলে।
হেলাল হাফিজ মাত্রাবৃত্তের ঢেউয়ের দোলায়ও ভাসিয়েছেন তাঁর কবিতার নাও। মাত্রাবৃত্তের দোলা ধীর লয়ের, গানের সমধর্মী। তাঁর আবেগধর্মী, গীতিময়ী কবিতা গদ্যছন্দ বা অক্ষরবৃত্তের পাশাপাশি হেঁটেছে মাত্রাবৃত্তের চালে-
‘আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর
বাঁধবো নিমিষে।’
[হৃদয়ের ঋণ]
কখনো কখনো পূর্ণ পর্বের মাত্রা সংখ্যা হ্রাস বৃদ্ধি করে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের দোলায় বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছেন-
‘তোমাকে শুধু/তোমাকে চাই/পাবো?
পাই বা না পাই/এক জীবনে/তোমার কাছেই/যাবো।
[অমীমাংসিত সন্ধি]
এখানে পূর্ণপর্ব পাঁচমাত্রার হলেও দ্বিতীয় চরণে ৬ মাত্রার দুটি পূর্ণ পর্ব রয়েছে। মূলত এই কবিতাটি স্বর-মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। প্রথম পঙ্ক্তি ব্যতীত সম্পূর্ণ কবিতাটিই স্বরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে পাঠ করা যায়।
স্বরবৃত্ত লঘু চপল ছন্দ। হালকা চটুল ভাব প্রকাশের উপযোগী এই ছন্দ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘ক্ষণিকা’ কাব্যসহ তাঁর বিভিন্ন কবিতায় স্বরবৃত্তের অন্তর্নিহিত শক্তি উদঘাটন করে দেখিয়েছেন। এই চপল ছন্দে হেলাল হাফিজও তার গুরু বক্তব্য প্রকাশ করেছেন-
‘জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রæপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুণ তাপস এই নে চারু শীতল কলস।’
[যাতায়াত]
স্বরবৃত্তে রচিত কবিতাগুলোর কোথাও কোথাও পেয়েছে স্বরমাত্রিকতার ছোঁয়া। যা কবিতাকে আরো পাঠস্বাদু করে তোলে এবং তাঁর ছন্দ সচেতনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আদি কবি বাল্মীকির কণ্ঠে যেদিন প্রথম কবিতা উচ্চারিত হয়েছিল, তা ছিল ছন্দে গাঁথা। তাছাড়া বাংলা কবিতার প্রত্যেকটা বাঁক বদলেই ছন্দের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত ছন্দই চিহ্নিত করে একজন মৌলিক কবির কণ্ঠস্বর। হেলাল হাফিজ ছন্দের ব্যবহার তার কবিত্ব শক্তির বহিঃপ্রকাশ। পাঠকের কাছে তাঁর কবিতার এই অফুরন্ত আবেদনের নেপথ্যে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ছন্দেরও মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। সময় পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু হেলাল হাফিজ যে কষ্টটাকে নির্মাণ করেছেন পাঠকের এই নির্জ্ঞান মন সেই কষ্টের একটা লিগ্যাসি তৈরি করেছে। কবি নিজেকে আরেক কবিতায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন—‘দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ’ বলে।