হাসান হামিদ-

সেদিন বেইলি রোডের আড্ডায় আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল উৎপলকে নিয়ে। পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নামের অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদক উৎপল দাসের নিখোঁজ  হওয়ার পর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। অথচ তাঁর কোনো হদিস মিলছে না। পেশাগত দিক দিয়ে  তাঁর সাথে আমাদের মিল নেই যদিও; যদিও তাঁকে চিনি না আমরা, তারপরও এক পরিবারের আহাজারি আমাদের মন ভরাক্রান্ত করে দেয়, রাতের বাতাস ভারী হয়ে যায়, আমাদের দম বন্ধ লাগে! জেনেছি উৎপল দাস এমন কোনো রিপোর্ট করেননি যা সরকার বা বিরোধী দল অথবা কোনো রাজনৈতিক শক্তির বিপক্ষে গেছে। তাহলে কী হয়েছে তাঁর? এই যদি হয় আমাদের ছয় নম্বর মৌলিক চাহিদার অবস্থা, তবে আমরা নিরাপদবোধ করি না কোথাও যেতে। খুব খারাপ লাগে যখন শুনি পুলিশ বিভাগের কাছে তাঁর আকস্মিক অন্তর্ধান নিয়ে এ পর্যন্ত দুটি সাধারণ ডায়েরি করা হলেও তদন্তে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাঁর পারিবারিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, কারও সঙ্গে তাঁর এমন কোনো দ্বন্দ্ব বা শত্রুতা ছিল না।

এরপর রোববার সন্ধ্যার দিকে উৎপলের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। আমরা দেখেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এ নিয়ে স্ট্যাটাস দেন অনেকে। উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাসকে মোবাইলে উৎপল মির্জাপুরের একটি হাসপাতালে তার অবস্থানের কথা জানিয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু পরে মির্জাপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে তল্লাশি চালানো হয়। তবে তাঁকে পাওয়া যায়নি। গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর মতিঝিলের অফিস থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার উৎপল। নিখোঁজ হওয়ার পরপরই বন্ধ হয়ে যাওয়া তাঁর মুঠোফোন থেকে অর্থ দাবি করে আসা কলটিও  বিশেষভাবে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে যাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করছে। কারণ, পুলিশ নিশ্চিত করেছে, ফোন কলটি তাঁর মুঠোফোন থেকে আসেনি। পুলিশের সন্দেহ, স্পুফিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতে পারে। কারণ, এই প্রযুক্তিতে যেকোনো নম্বর কল গ্রহীতার মুঠোফোনের পর্দায় দেখানো সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে সংশ্লিষ্ট নম্বরের ব্যবহার না-ও ঘটতে পারে। পুলিশের এই ধারণা সত্য হলে এটাই নির্দেশ করে যে শুধু অর্থ আদায়ের জন্য উৎপল অপহরণের ঘটনা না-ও ঘটতে পারে। মুক্তিপণ আদায় যদি অপহরণকারীদের লক্ষ্য হতো, তাহলে সেটা অবহিত করতে তাদের এতো দিন সময় নেওয়ার কথা নয়। আমরা জানি না সত্যিটা আসলে কী। তিনি কী এমন মত প্রকাশ করে থাকতে পারেন যে কারণে তাঁকে গুম হয়ে যেতে হবে?

আমরা আশা করি, পুলিশ এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করতে চাইলে তারা সেটা করতে সক্ষম হবে। একটি বাহিনী হিসেবে পুলিশকে তার বৈধ সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতে হবে। দেশের নাগরিক হিসেবে অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রতিটি নাগরিকের ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এটা নিশ্চিত করা হয়েছে। সুতরাং সরকারের কাছে থাকা তথ্য জানার অধিকারও  জনগণের রয়েছে। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ হলে, রাষ্ট্রের সরকারের কাছে থাকা তথ্যের মালিক ও জনগণ। এ ধারণা থেকেই তথ্যঅধিকার আইনের সৃষ্টি। সাংবাদিকরা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, দুর্নীতি ও সমাজের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। পেশার তাগিদেই সামাজিক দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকরা। নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয় পেশার তাগিদেই। তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে হয়।

মানুষ নামের কাঙাল! যুগ-যুগান্তর ধরে মানুষ তার সুনামকে সুরক্ষা দিয়েছে। মানুষ নামের জন্য কতখানি কাঙাল তার গভীরতা বোঝা যায় শেক্সপিয়ারের ‘ওথেলো’ নাটকে নায়ক তার এক বক্তব্যে বলেছেন ‘সে তার সুনাম কেড়ে নিয়েছে, কেড়ে নেয়া সেই সুনাম তাকে সমৃদ্ধ করেনি কিন্তু আমাকে নিঃস্ব বানিয়ে ছেড়েছে।’ প্রকাশিত কোনো বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যদি আরেকজনের মর্যাদা, শ্রদ্ধা, সুনাম ও আস্থা খর্ব হয় তবে তাকে মানহানি বলা হয়। সংবাদপত্র স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারী হলেও মানহানি সংক্রান্ত আইনের অধীন। পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প, শিরোনাম, সম্পাদকীয়, কার্টুন, বিজ্ঞাপনের দ্বারা মানহানি হতে পারে। এমনকি বেতার বা টেলিভিশনের মাধ্যমেও অনুরূপভাবে মানহানি হতে পারে। আর সেটা যদি করে থাকেন কেউ তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু রাষ্ট্র সাংবাদিকদের নিরাপত্তা না দিতে পারায় আজকে উৎপল কোথায় আছেন কেউ জানে না!

সাংবাদিকতা নতুন কোন পেশা নয়। এর রয়েছে অনেক পুরোনো ইতিহাস। ঘটনার বিবরণ প্রদান এবং তথ্য যোগান প্রথা বাংলা ও ভারতের অন্যান্য অংশে প্রাচীন এবং মধ্যযুগেও সাংবাদিকতা সীমিতভাবে চালু ছিল। প্রাচীন ভারতে পাথর বা স্তম্ভে খোদিত শব্দাবলি তথ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হতো। সম্রাট অশোক পাথর ও স্তম্ভে খোদিত আদেশ তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র এবং বাইরেও প্রজ্ঞাপন করেন। তিনি তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশে এবং বিদেশে গুপ্তচর নিয়োগ করেন। সুলতানি আমলে ‘বারিদ-ই-মামালিক’ বা গোয়েন্দা প্রধান কর্তৃপক্ষকে সাম্রাজ্যের তথ্য সরবরাহ করার দায়িত্ব পালন করতেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির মুনহি বা গুপ্তচররা সুলতানকে অতি তুচ্ছ বিষয়সমূহও অবহিত করত। মুগল শাসনামলে সংবাদ সার্ভিস নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘ওয়াকই-নবিশ’, ‘সাওয়ানিহ-নবিশ’ এবং ‘খুফিয়ানবিশ’ চালু ছিল। এ ছাড়াও ‘হরকরা’ এবং ‘আকবর-নবিশ’ নামে সুলতানদের সাধারণ তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল। ভাট, কথক এবং নরসুন্দর মানুষকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক খবর জানাত। কিন্তু মুগল আমলের বাংলায় সাংবাদিকতা ছিল শুরুর পর্যায়ে, প্রকৃত অর্থে সাংবাদিকতা হিসেবে বিষয়টি তখন বিকশিত হতে পারেনি।  তবে আধুনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাংবাদিকতার উৎপত্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে। উপনিবেশ হওয়ার কারণে এশিয়ার অন্য যে কোন দেশের আগেই বাংলা অঞ্চলে সাংবাদিকতা শুরু হয়। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত জেমস অগাস্টাস হিকি-র বেঙ্গল গেজেট প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলায় আধুনিক সাংবাদিকতার ইতিহাস শুরু হয়। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে উলে­খ করা হয়েছিল, সকল পক্ষের জন্য উন্মুক্ত হলেও এটি কারও দ্বারা প্রভাবিত নয় এমন একটি সাপ্তাহিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পত্রিকা। ১৮১৮ সালে বাংলা সাংবাদিকতা যাত্রা শুরু করে। সে বছর বাঙ্গাল গেজেট (কলকাতা), দিগদর্শন (কলকাতা) এবং সমাচার দর্পণ (শ্রীরামপুর) নামে তিনটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল।

সাংবাদিকতা পেশা এক নতুন মোড় নেয় বিশ শতকের শুরুতে। জাতীয়বাদী আন্দোলন, মুসলিম জাতীয়তাবাদের উত্থান, প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের সূচনা প্রভৃতি কারণে সংবাদপত্রসমূহের চাহিদা ও পাঠকসংখ্যা দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং পূর্ববাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার উত্থান সাংবাদিকতার বিস্তারের ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করে। সম্মানজনক পেশা হিসেবে বিবেচিত, যদিও দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এই পেশাকে বিশেষ দুঃসাহসী কাজে পরিণত করেছে। কোন কোন সময় ঘটনার সঠিক তথ্য ও বিশে­ষণের জন্য সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক দলের চেয়ে সাংবাদিকদের ওপর বেশি নির্ভর করে। অপরদিকে তথ্য সংগ্রহ এবং ঘটনার বিবরণের জন্য সবাংবাদিকরা কখনও কখনও সরকারসহ কায়েমি স্বার্থের আঘাতের লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত হয়। সে কারণেই কায়েমী স্বার্থের দ্বারা সাংবাদিকের প্রতি হামলা, খারাপ আচরণ, পঙ্গু করে দেয়া, এমনকি হত্যাকান্ডের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে থাকে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বলা যায়, এখনও খানিকটা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পথ চললেও ক্রমশ তা পেশাদারিত্ব নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কি রাষ্ট্র দেবে না? সাংবাদিক হত্যা এবং নির্যাতনের ঘটনায় আইনের শাসন কার্যকর করা প্রয়োজন। প্রতিটি সাংবাদিক হত্যার বিচার হতে হবে।  যদি এই ঘটনাগুলোর বিচার না হয় তবে অপরাধীরা অপরাধ করার জন্য স্বাধীনতা পেয়ে যাবে। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়ার প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হবে। এ জন্য সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়াগুলো আরও গতিশীল করতে হবে। দুঃখজনক যে, আমরা এখনো সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার পাইনি। এখন পর্যন্ত মানিক সাহাসহ হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু অনেক বিচারই এখনো হয়নি। দ্রুত বাকি সাংবাদিক হত্যা মামলাগুলোর বিচার করতে হবে। একটি নিরীহ সাধারণ পরিবার থেকে আসা সংবাদকর্মী উৎপল দাস নিখোঁজ থেকে গেলে কি রাষ্ট্র তার দায় এড়াতে পারে? উৎপলের পরিবারের মত এখন আমাদের দেশে অনেকে ভয়ে দিন পার করেন। কখন না জানি কে নিঁখোজের তালিকা্য চলে যায়। কিন্তু আমরা এই রাষ্ট্র আর তার আইন শৃঙ্ক্ষলা বাহিনীর উপর আস্থা রাখতে চাই। আমাদের দিন যেনো দুর্ভাবনার আর উৎকন্ঠার না হয়। আমাদের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রযন্ত্র যেনো ব্যর্থ না হয়!

লেখক – গবেষক ও সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn