সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগঃ চিহ্নিতরা গ্রেপ্তার হবে তো?
২০১২ সালের ৮ জুলাই পুড়ানো হয়েছিলো সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাস। দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠা এই ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন সরকারের থেকে শুরু করে দায়িত্বশীলরা। কিন্তু পাঁচ বছরেও অগ্নিসংযোগকারীদের চিহ্নিত করতেই পারেনি পুলিশ। এইসময়কালে পুলিশ, সিআইডি, পিআইবি তদন্ত করলো ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার। কিন্তু কারা আগুন লাগিয়েছে তা-ই খুঁজে বের করতে পারেনি এসব সংস্থা। আগুন দেওয়ার ঘটনার ভিডিওচিত্রে ছাত্রলীগ কর্মীদের দেখা গেলেও পুলিশের তদন্তে উঠে আসেনি তাদের নাম। অবশেষে চিহ্নিত হলো অগ্নিসংযোগকারীরা। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটিতে অগ্নিসংযোগের সাথে সম্পৃক্ততার জন্য চিহ্নিত হলো ২৯ জন। যাদের প্রায় সবাই-ই ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। গত ১৫ নভেম্বর সিলেট চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্র্যাট আদালতে ২৯ জনকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দাখিল করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। পরদিন বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক উম্মে সরাবন তহুরা এই ২৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর প্রশ্ন উঠেছে এরা গ্রেপ্তার হবে তো? আসামীদের প্রায় সকলেই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও নেতাদের অনুসারী হওয়ায় এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এরআগে গত ১৯ অক্টোবর সিলেট নগরীর ফুটপাত দখল ও দখলদারদের আশ্রয় প্রদানের অভিযোগে ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে মহানগর মূখ্য হাকিম আদালত। তবে এদের একজনকেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। সেই পরোয়ানার শীর্ষে নাম থাকা মহানগর হকার্স লীগ ও মহানগর হকার্স কল্যান সমবায় সমিতির সভাপতি রকিব আলী প্রকাশ্যে মিছিল মিটিং করলেও পুলিশ বলছৈ তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাতের দখলদাররাই গ্রেপ্তার না হওয়ায় এমসি কলেজের অগ্নিসংযোগকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে কী না এই প্রশ্ন আরও জোড়ালোভাবে উঠেছে। তবে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) এম এ ওয়াহাব এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরডটকমকে বলেন, ‘আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এখনো পুলিশের হাতে পৌঁছেনি। পরোয়ানা হাতে পাওয়ামাত্র আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হবে।’
যাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা: সিলেট সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমানে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠু, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক (বরখাস্ত) সভাপতি পংকজ পুরকায়স্থ, আবু সরকার ( শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি), জাহাঙ্গীর আলম (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), মৃদুল কান্তি সরকার, কামরুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন (সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে আইনজীবী ও বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউপি চেয়ারম্যান), বাবলা, মো. আতিকুর রহমান, লায়েক আহম্মেদ, সিদ্দিক আহম্মেদ ইউসুফ, জহিরুল ইসলাম, আক্তারুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, আসাদুজ্জামান শাহিন, মোহাম্মদ বিন মামুন বুলবুল, আউলাদ, আছরাফ আহমেদ শিপন, নজরুল ইসলাম, অলিউল্লাহ ওরফে ওলিউর রহমান, খুরশেদ আলম, বাছিদ ওরফে আবদুল বাছিদ, আবদুস সালাম, ইমতিয়াজ রফিক চৌধুরী, আবদুল্লাহ ফারুক, কয়েছ ওরফে কয়েছুজ্জামান তালুকদার, আবু রেহান, রুবেল ও জ্যোতির্ময় দাস সৌরভ। ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের বিরোধের কারণে এই নাশকতা চালানো হয়েছে বলেও বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। তদন্তের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ছাত্রাবাস পোড়ানোর মামলার বাদীসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি ফের গ্রহণ করা হয়। ফলে সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র, জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের বিরোধের কারণেই সংঘটিত হয়েছে।
প্রথমত ছাত্রলীগের কর্মী উজ্জ্বল আহমদকে ছাত্র শিবিরের কর্মীরা গুরুতর জখম করায় তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য বিচার বিশ্লেষণে এটা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত বলে পর্যালোচনায় বলা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ছাত্রাবাসে আগুন দিতে গ্যালনে করে পেট্রোল ব্যবহার করা হয়। পরে ছাত্রাবাস কক্ষ লুটপাটও হয়। এ ব্যাপারে এক সাক্ষী বলেছেন-‘ছাত্রাবাস যখন আগুনে পুড়ছিল, তখন রামদা উঁচিয়ে মিছিল করেছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পুলিশ ছাত্রাবাসের ফটকের সামনে উপস্থিত থাকলেও নীরব ছিল। পরে ছাত্রলীগের একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশও হয় ছাত্রাবাস ফটকে’। আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিলেট পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। এরপর সিআইডি ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর আদালতে প্রথমবার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।
এরপর আবার তদন্ত করে সিআইডি ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট ফের আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনও আদালত গ্রহণ না করে পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের মাধ্যমে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দুই বার ও বিশেষায়িত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তে অপরাধী শনাক্ত না হওয়ায় আলোচিত এ মামলার ভবিষৎ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। সর্বশেষ এ মামলার জট খুলতে গত ৩১ মে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে সারাবন তহুরা। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৮ জুলাই শিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জের ধরে ছাত্রবাসে দেওয়া আগুনে ৪২টি কক্ষ পুড়ে যায়। এ ঘটনায় হল সুপার বশির আহমদ বাদী হয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় ২০১২ সালের ১৩ জুলাই মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে এ ঘটনায় আরও দুটি মামলা করা হয়।