ফেসবুকে বন্ধুতা, প্রেম ব্ল্যাকমেইল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বন্ধুতা। মিথ্যা পরিচয় ও তথ্য ব্যবহার করে নিজেকে উপস্থাপন করে সে। নানা প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে তরুণীদের। গড়ে তোলে প্রেমের সম্পর্ক। একপর্যায়ে ব্ল্যাকমেইল। শুধু তরুণীদের শরীর, মন নয়, কেড়ে নেয় সর্বস্ব। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, স্বর্ণ ও নগদ টাকা কোনো কিছুই বাদ যায় না তার কবল থেকে। এরকম একটার পর একটা ঘটনার জন্ম দিলেও ধূর্ত ওই যুবককে খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার প্রতারণার শিকার হয়েছেন সরকারি মেডিকেল কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী। তাদের মধ্যে কয়েক তরুণী অভিযোগ করেছেন থানা পুলিশে। বাকিরা সামাজিক কারণে থানা পুলিশমুখো হননি। অভিযোগকারী তরুণীরা জানিয়েছেন, তারা দিনের পর দিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি ভাইরাল করার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের এক তরুণীর সঙ্গে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ফেসবুকে পরিচয় হয় ওই যুবকের। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচারের ছাত্রী তিনি। ওই যুবক নিজের নাম সাকিব খান এবং নিজেকে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পরিচয় দিয়ে ওই তরুণীর সঙ্গে বন্ধুতা গড়ে তোলে।
দিনভর মেসেঞ্জারে চ্যাট হতো তাদের। অতঃপর শুরু হয় ফোনালাপ। সারাদিনই ফোন যোগাযোগ হতো। রাত গভীর হলে গভীর হতো ফোনালাপও। একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতো ফোনে। বন্ধুতার দেয়াল টপকে প্রেমের সম্পর্ক জড়িয়ে যায় ভার্চুয়াল পরিচয়ের সূত্র ধরে। প্রথমে যমুনা ফিউচার পার্কে দেখা হয় দু’জনের। তারপর বিভিন্নস্থানে। একান্তে সময় কাটিয়েছেন তারা। ধারণ করা হয়েছে বিশেষ মুহূর্তের ছবি। ওই ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক এভাবেই এগিয়ে নিয়ে যায় সাকিব খান। হিসেবটা মাত্র দু’ মাসের। সম্পর্কের দুই মাসের মধ্যেই ঘটে ঘটনাগুলো। গত ২১শে ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত খেলাটি খেলে এই যুবক। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীকে ফোনে ডেকে নেয় উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের রাজলক্ষ্মী মার্কেটের সামনে। সেদিন বেলা পৌনে ১টার দিকে দেখা হয় দু’জনের।
সেখান থেকে উত্তরা সাত নম্বর সেক্টরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে নর্থ টাওয়ারের সামনে নিয়ে যায় ওই ছাত্রীকে। কথায় কথায় নিজের ব্যস্ততার কথা জানান দিচ্ছিলো যুবক। প্রকাশ পাচ্ছিলো তার অস্থিরতাও। গল্পছলে ওই ছাত্রীর মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে টাকা উত্তোলনের জন্য বিকাশের দোকানে যায় সে। ছাত্রী দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। পাশের একটি সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ফেসবুক লগইন করে ‘থ’ হয়ে যান। ফোনটি হাতে পেয়ে অল্পসময়ের মধ্যেই ছাত্রীর ফেসবুকের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করেছে সাকিব।
তারপর ১লা মার্চ। ততদিনে ফেসবুকে নতুন আইডি করেছেন ওই ছাত্রী। সেই আইডিতে ক্ষুদের্বাতা। টাকা দাবি করেছে সাকিব। টাকা না দিলে ব্যক্তিগত ছবিগুলো ফেসবুকে ভাইরাল করা হবে। পুরো পৃথিবীটাই যেন উল্টে যায় তার। যার সঙ্গে দিনে-রাতে, সময়ে অসময়ে এতো ঘনিষ্ঠতা, শেষ পর্যন্ত সেই তার মর্যাদাহানি করবে। পরিবার, প্রতিবেশী, চেনাজনদের কাছে..। এসব ভাবতে ভাবতে বারবার সাকিবের ফোনে কল দেন। বন্ধ পান। নিজের ফোন নম্বরে (যে ফোনটি সাকিব নিয়ে গেছে) কল দিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। অভিন্ন কথা। টাকা দিতে হবে। বিকাল ৪টার মধ্যে। নতুবা ছবিগুলো ভাইরাল হবে। বাধ্য হয়েই সাকিবের দেয়া বিকাশ নম্বরে টাকা সেন্ট করেন দু’দফা।
এভাবে প্রায়ই ছবিগুলো প্রকাশের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হয় ছাত্রীর কাছ থেকে। বাধ্য হয়ে গত ৬ই মার্চ উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন ওই ছাত্রী। এতে ওই যুবকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে ক্যাপ্টেন সাকিব খান (৩১)। পিতার নাম মেজর (অব.) সিহাব উদ্দিন। বাসার ঠিকানা রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার রেলস্টেশন সংলগ্ন। থানা থেকে মামলাটি এখন সিটিটিসি’র সাইবার ক্রাইম ইউনিটে। তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. নাজমুল নিশাত জানান, ধারণা করা হচ্ছে সাকিব তার প্রকৃত নাম না। উল্লিখিত ঠিকানায় ক্যাপ্টেন সাকিব ও মেজর সিহাব উদ্দিন নামে কারও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার ও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সূত্রমতে, বিকাশে যে দুটি নম্বরে টাকা নেয়া হয়েছে তার একটি ময়মনসিংহে, অন্যটি পাবনার ঈশ্বরদিতে। ইতিমধ্যে ওই যুবকের বিরুদ্ধে একই ধরনের আরো অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীর মতোই ওই যুবকের প্রতারণার শিকার হয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রী। ফেসবুকে বন্ধুতা থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। সর্বশেষ মেডিকেলের ওই ছাত্রীকেও ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। ফেসবুকে দেয়া ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে প্রতারক একই যুবক। তবে ধূর্ত ওই যুবক তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।