সৈয়দ রাসেল- :: মাত্র ৯০ দিনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সিলেট মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি। ওই আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই ৩ বছর পার করে দিয়েছে সংগঠনটি। মহানগরজুড়ে একক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে ওই আহ্বায়ক কমিটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করছে না; নেতাকর্মীদের এমন অভিযোগ থাকলেও যুবলীগ থেকে ‘বিতাড়িত হওয়ার ভয়ে’ এ নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। তাছাড়া সমন্বয়ের অভাবে পুরো কমিটি থেকেই অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন সংগঠনের আহ্বায়ক আলম খান মুক্তি। ফলে কার্যত অচল হয়ে আছে সিলেট মহানগর যুবলীগ। ২০১৪ সালের ৭ জুলাই আলম খান মুক্তিকে আহ্বায়ক এবং মুশফিক জায়গীরদার, আসাদুজ্জামান আসাদ, সাইফুর রহমান খোকন ও সেলিম আহমেদ সেলিমকে যুগ্ম আহবায়ক করে ৬১ সদস্যের মহানগর যুবলীগের কমিটি অনুমোদন দেয় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি। এর মেয়াদ বেঁধে দেয়া হয়েছিল ৯০ দিন। এ সময়ের মধ্যে সকল ওয়ার্ডের সম্মেলন করে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কথা ছিল; কিন্তু দীর্ঘ ৩ বছর ৪ মাস পরও সেই আহ্বায়ক কমিটিতেই মহানগর যুবলীগের পরিধি আটকে আছে।

এ জন্যে মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আলম খান মুক্তিকেই দায়ি করেছেন একই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুর রহমান খোকন। তিনি বলেছেন, ‘শর্ত ছিল ৩ মাসের মধ্যে সকল ওয়ার্ডের কমিটি করে সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মহানগর কমিটি করতে হবে। তবে কোনো কারণে যদি আহ্বায়ক কমিটি তাতে ব্যর্থ হয় তাহলে কেন্দ্রীয় কমিটি বরাবর আবেদন করে আরো ৩ মাস সময় বাড়াতে পারে; কিন্তু তা না করে ইচ্ছাকৃতভাবে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এটা আহ্বায়কের একক ব্যর্থতা।’  তিনি আরো বলেন, ‘‘অনেক ওয়ার্ড কমিটি ঘরে বসে করা হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী হয়নি। যারা প্রকৃত যুবলীগ নেতাকর্মী তাদের বাদ দিয়ে ‘হাইব্রিড’ দিযে এসব ওয়ার্ড কমিটি করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে যুবলীগের পুরোনো নেতাকর্মীদের। তারা হতাশ। মহানগরীতে যুবলীগের অবস্থান নেই বললেই চলে। যেসব কর্মসূচি পালিত হয় তা আসলে ব্যক্তিকেন্দ্রীক-ফোরামে কোনো আলোচনা না করেই করা হয়। সবাইকে নিয়ে কিছু হচ্ছে না।’’এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনি প্রকৃত মুজিব আদর্শের সৈনিকদের দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে আলম খান মুক্তি বলেন, ‘‘মহানগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে এ পর্যন্ত ২০টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে গিয়ে ‘বহিরাগত’ ও ‘হাইব্রিড’দের বাদ দিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করে কমিটি করতে হয়েছে। এতগুলো কমিটি করতে একটু দেরি তো হবেই। যেখানে মহানগর আওয়ামী লীগ অনেক ওয়ার্ড কমিটিতে এখন পর্যন্ত হাতই দিতে পারছে না সেখানে যুবলীগের ক্ষেত্রে এমনটা হতেই পারে।’’

এদিকে সিলেট মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর আহ্বায়কের ভূমিকা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক যুগ্ম আহ্বায়ক নিজেদেরকে সাংগঠনিক কর্মকা- থেকে গুটিয়ে নেন। একই অভিযোগে আহ্বায়ক কমিটি থেকে সরে গেছেন অধিকাংশ সদস্য। এতে সংগঠনটি চরম নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এসব অভিযোগের সাথে সুর মেলালেন মহানগর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শান্ত দেব। তিনি বলেন, ‘৩ মাসের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সকল ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে পারেনি বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি, যে কারণে অর্থমন্ত্রীও রাগ করেছেন। এছাড়া সংগঠনের মধ্যে চলছে স্থবির অবস্থা। কার্যক্রম নেই। ওয়ার্ড কমিটিগুলো ঠিকমতো করা হয়নি। ত্যাগী কর্মীরা আছে; কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে ‘বহিরাগত’দের দিয়ে কমিটিগুলো করা হচ্ছে।’’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির অধিকাংশ সদস্য নিষ্ক্রিয়। নেতৃস্থানীয়দের নাজুক অবস্থা দেখে নতুন করে কেউ এতে যুক্ত হতেও চাচ্ছে না। আসলে সাধারণ নেতাকর্মীরা হতাশ। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল পর্যায়ে যদি সংগঠনকে শক্তিশালী করা না যায় তাহলে আওয়ামী লীগ বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবে।’ একই অভিযোগ করলেন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনি বলেন, ‘একটা অদৃশ্য শক্তির কারণে সম্মেলন হয়নি, জোরালো কোনো কার্যক্রমও নেই। তবে নিজেদের মধ্যে সবসময়ই কমিটির ব্যাপারে আলোচনা হয়।’
আহ্বায়ক কমিটির দুর্বলতা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাদেরও দুর্বলতা আছে। উপর থেকে কমিটি হলে যা হয় তা-ই হচ্ছে। তৃণমূলের চাহিদা অনুযায়ী তো কমিটি হয়নি, হঠাৎ করে একটা কমিটি দেয়া হয়েছে। ফলে এসব সমস্যা তৈরি হয়েছে।’ মহানগর যুবলীগের বর্তমান নেতৃত্বের ব্যপারে মহানগর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল লতিফ রিপন বলেন, ‘‘আগে মহানগরীর প্রতিটা ওয়ার্ডে যুবলীগের একটা ভিত্তি ছিলো, এখন তা নেই। ‘বহিরাগত’ আর ‘হাইব্রিড’ দ্বারাই চলছে ওয়ার্ড যুবলীগ।’’ তিনি নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘প্রকৃত নেতাকর্মীদের দিয়ে’ ২৭টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন করে সংগঠনকে গতিশীল করার লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ মহানগর কমিটি গঠন করার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কাছে দাবি জানান।বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মহানগর যুবলীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের নানা অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না শর্তে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির অনেকে জানান, বর্তমান আহ্বায়ক সংগঠনকে গতিশীল করার পরিবর্তে নিজের টিকে থাকার লড়াই নিয়েই ব্যস্ত। সপ্তাহের অধিকাংশ সময় তিনি ঢাকায় কাটান। অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সিলেট এলে তাদেরকে স্বাগত এবং বিদায় জানানোই যেন বর্তমান কমিটির কাজ। অনেক কর্মসূচি দেয়া হয় যেগুলো দুয়েকজন ছাড়া আহ্বায়ক কমিটির আর কেউ জানে না। এ অবস্থায় সংগঠনে দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা।
সমন্বয়হীনতার প্রশ্নে আলম খান মুক্তি বলেন, ‘এটা সব কমিটিতেই থাকে। সবাইকে খুশি করা সম্ভব নয়, আবার সবাই যে আমাকে ভালোবাসে তাও ঠিক নয়, কিছু লোক আমাকে খারাপ পেতেই পারে।’ তিনি দাবি করেন, বর্তমান সময়ে যুবলীগ ‘সিলেটের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন’। চলমান আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর যুবলীগের দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, ‘আগামী ৯০ দিনের জন্য ওই কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সিলেট মহানগরের অন্তর্ভুক্ত সব ওয়ার্ড, ইউনিটগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে হবে।’ সেই সঙ্গে সিলেট মহানগরের কাউন্সিল সম্পন্ন করার জন্য আহ্বায়ক কমিটিকে নির্দেশনা দেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক।  যুবলীগের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ফজলুল হক আতিক বলেন, ‘আলম খান মুক্তি সাংগঠনিক মানুষ। তবে তার যথেষ্ট ব্যর্থতা আছে। এছাড়া নেতাকর্মীদের সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাবও রয়েছে তার।’ মহানগর যুবলীগের কমিটির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যুবলীগে একক ক্ষমতা হচ্ছে চেয়ারম্যানের। আমি সাংগঠনিক রিপোর্টগুলো জানাই, সিদ্ধান্ত নেন চেয়ারম্যান। আমরা কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সামনে নির্বাচন, ঠিক এ সময় যদি আমরা সম্মেলনটা করি তাহলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে। তাই নির্বাচনের পরে কমিটি করা হবে-এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাছাড়া সিলেট আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দও চাইছেন নির্বাচনের পরে কমিটি করতে। এজন্য আপাতত মহানগর কমিটি করা হচ্ছে না।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn