আসিফা ধর্ষণে রাজনৈতিক রঙ
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং প্রতিবেশী দেশগুলো একটি আরেকটির চেয়ে খুব আলাদা নয়। বিশেষ করে মেয়েদের সমানাধিকারের ব্যাপারে। সমানাধিকার তো এখনো স্বপ্ন, অধিকারই যেখানে জোটে না। বৈষম্যহীন পরিবেশে বড় হওয়ার অধিকার প্রতিটি মেয়েরই আছে, কিন্তু প্রতিটি মেয়েই তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। লেখাপড়া করার, ঘরের বাইরে বের হওয়ার, যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার, নিরাপত্তা পাওয়ার, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার, নিজের পছন্দে নিজের জীবনযাপন করার, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার ক’টা মেয়ে পায়? সব দেশেই মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে শুধু মেয়ে বলেই। মেয়েদের খাবার কম দেওয়া, মেয়েদের কথা বলতে না দেওয়া, মেয়েদের হাসতে না দেওয়া, মেয়েদের চড়-থাপড়, কিল-ঘুষি, লাথি-গুঁতো দেওয়া—এগুলো সংসারে ডালভাতের মতো স্বাভাবিক। শারীরিক নির্যাতন করা, কেরোসিন ঢেলে শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, হত্যা করে আবর্জনার স্তূপে ফেলে রাখা এগুলো তো আছেই, সবচেয়ে বেশি যে নির্যাতন মেয়েদের করা হয়, সেটি যৌন নির্যাতন। আগে তো ভাবতাম মেয়েরা ঋতুবতী হওয়ার পর মেয়েদের প্রতি পুরুষের যৌন আকর্ষণ জন্মায়, ঠিক যেমন মেয়েদেরও পুরুষের প্রতি আকর্ষণ জন্ম নেয়। কিন্তু চার-পাঁচ বছরের শিশু এমনকি এক বছর বয়সী শিশুর প্রতি কী করে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের এই আকর্ষণটি জন্মায়?
পিডোফিলিয়া নামে একটি মানসিক রোগ যদি থাকে, তাহলে আকর্ষণ জন্মায়। কিন্তু এই যে শিশু ধর্ষণ হচ্ছে চারদিকে, এগুলো যে পিডোফাইলরা বা শিশুপ্রেমীরা করছে তা কিন্তু নয়। শিশু ধর্ষকদের অধিকাংশই বিবাহিত, সন্তানাদি আছে, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের প্রতিও তাদের যৌন আকর্ষণ কিছু কম নয়। যৌন আকর্ষণ অন্যায় নয়। ধর্ষণ অন্যায়। পিডোফাইলদের অধিকার নিয়ে আজকাল পাশ্চাত্যের দেশগুলো সরব হচ্ছে। শিশুদের প্রতি পিডোফাইল বা শিশুপ্রেমীদের যে যৌন আকর্ষণ সেটি তাদের মস্তিষ্কে, সেটি নিয়েই তারা জন্মেছে। সুতরাং এই অনাকাঙ্ক্ষিত আকর্ষণের জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। পিডোফিলিয়া রোগটিকে চিকিৎসা দিয়ে দমন করা যায়, কিন্তু সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায় না। তাদের আকর্ষণ নিয়ে তারা থাকুক, কিন্তু শিশুদের কোনও ক্ষতি না করুক, শিশুদের দিকে হাত না বাড়াক। তাহলেই তো সমাজের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। সমাজের ক্ষতি বরং তারাই বেশি করছে যাদের মস্তিষ্কে কোনও রোগ নেই, তারা সুস্থ মস্তিষ্কে ঠাণ্ডা মাথায় নারীর প্রতি অসম্ভব ঘৃণা আর বিদ্বেষ ধারণ করে একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও শিশু ধর্ষণ হৈহৈ করে বাড়ছে। শিশুদের শুধু ধর্ষণের শিকার করছে না, গণধর্ষণ করে করে হত্যা করছে। এই মানুষগুলোই আবার সবার সঙ্গে ট্রেনে বাসে চাপছে, সবার সঙ্গে অফিসে যাচ্ছে, সংসারে ফিরছে, বাবা মা ভাই বোনদের সঙ্গে বা স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে আর দশটা পুরুষের মতোই জীবনযাপন করছে। ধর্ষক আর খুনি দেখতে আমাদের মতোই মানুষ, তারা আমাদের সঙ্গে আমাদের সমাজেই বাস করে।
বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হচ্ছে মানুষ। ভারতেও অভ্যস্ত হচ্ছে। পাকিস্তানে এবং আশপাশের দেশগুলোতেও একই হাল। শিশুদের পাচার করে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়, কারণ পতিতালয়ে শিশুর চাহিদা প্রচণ্ড। ঠিক যেমন পতিতালয়ে শিশু ধর্ষণ স্বাভাবিক, পতিতালয়ের বাইরেও এটি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। শিশুদের সঙ্গে যৌন মিলন হয় না। শিশুদের সঙ্গে যা হয়, তা হলো ধর্ষণ। পতিতালয়ে বয়স্ক পুরুষ গিয়ে শিশু খোঁজে ধর্ষণ করার জন্য। শিশুর চাহিদা বলে শিশুকে ধর্ষণ করার দামও হাঁকা হয় বেশি। সমাজে পতিতালয় বৈধ হলে শিশু ধর্ষণও বৈধ। মাঝে মাঝে পুলিশ গিয়ে পতিতালয় থেকে শিশুদের উদ্ধার করে বটে, কিন্তু ক’টা শিশু আর উদ্ধার করে। বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু বাল্যবিবাহ চলছে। কারণ কচি মেয়ের প্রতি লোভ সব বয়সী পুরুষের। যাদের ঘরে কন্যাসন্তান রয়েছে, তারা আতঙ্কে নীল হয়ে থাকে। কখন না জানি কন্যাকে কে বা কারা অপহরণ করে, ধর্ষণ করে, হত্যা করে। নিরাপত্তা নিয়ে এমনই তটস্থ বাবা-মা যে কন্যাকে ইস্কুলে দিয়ে আসা-নিয়ে আসার কাজ নিজেরাই করে, বাড়ির কাছের মাঠে খেলতে যেতে দিতেও ভয় হয় তাদের। হওয়ারই কথা। ঘরে বাইরে কোথাও শিশুদের নিরাপত্তা নেই। আমরা আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। কারণ কিছু পুরুষ— তাদের পৌরুষিক বীভৎসতা শিশুদের ওপরই দেখাতে চাইছে, কারণ শিশুদের ওপরই দেখানো সহজ বলে।
মাঝে মাঝে ভাবী, মানুষ নিশ্চয়ই প্রাণিজগতের সবচেয়ে চতুর, সবচেয়ে নির্দয়, সবচেয়ে বীভৎস প্রাণী। আসিফা নামের একটি আট বছরের শিশুকে ভারতের জম্মুর জঙ্গল থেকে তুলে নিয়ে বন্দী করেছে, কয়েকজন দশাসই পুরুষ মিলে টানা কয়েক দিন ধর্ষণ করেছে, তারপর মাথায় পাথর মেরে হত্যা করেছে। এই ঘটনা প্রচার হওয়ার পর থেকে পর্নো সাইটে আসিফার ধর্ষণের ভিডিও খোঁজার ধুম পড়ে গিয়েছে। এমনই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে এক্সভিডিওজ ডটকমে। গত কয়েক দিনে এক্সভিডিওজে ট্রেন্ডিংয়ের তালিকায় রয়েছে আসিফা। ধর্ষণের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে রাখে অনেক ধর্ষক। সেসব ভিডিও তারা যদি পর্নো সাইটগুলোতে পাঠিয়ে দেয়, তাহলেই তো আসিফার ধর্ষণ দৃশ্য দেখার সুযোগ মিলবে! আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কারা হন্যে হয়ে আসিফার ধর্ষণ ভিডিও খুঁজছে! আজকাল পর্নো সাইটগুলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, ‘বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে সেক্স হচ্ছে, বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, দেখবে এসো।’ যারা দেখছে, তারা তো আমাদের সমাজেরই লোক। তারাই হয়তো সুযোগ পেলে শিশু ধর্ষণ করে। জম্মুতে আসিফা ধর্ষণের সত্যিকার কী কারণ ছিল এখনো স্পষ্ট নয়। তবে মানুষ নানা কারণ দেখাচ্ছে। কারণগুলো সবই রাজনৈতিক। কেউ বলছে, আদৌ আসিফাকে ধর্ষণ করা হয়নি, কেউ বলছে, ধর্ষণ রোহিঙ্গারা করেছে, কেউ বলছে, কারসাজি জম্মু কাশ্মীরের মুখ্য মন্ত্রীর। কেউ বলছে, মেয়েটি মুসলমান বলেই ওকে ধর্ষণ করা হয়েছে, কারণ হিন্দুরা ঘৃণা করে মুসলমানদের, ওরা চায় না ওই অঞ্চলে কোনও মুসলমান থাকুক। আসল ঘটনা একদিন নিশ্চয়ই প্রকাশিত হবে।
ধর্ষণের পেছনে রাজনৈতিক কারণই দেখালে ধর্ষণের পুরুষতান্ত্রিক কারণটা আড়ালে চলে যায়। বলা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাস করার লোক আসিফাকে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত, সুতরাং হিন্দুত্ববাদ বিরোধীরা চিৎকার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে। যখন কংগ্রেসের, তৃণমূলের, সিপিএমের লোক ধর্ষণ করে, বিরোধী দলের লোক একই কাজ করে, ওদের নিন্দে করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটে। এই করে করে ধর্ষণের শিকারকে রাজনৈতিক ঘুঁটি করে ফেলা হচ্ছে। আমার মনে হয় মুসলমানদের জম্মু থেকে তাড়াতে চাইলে মুসলমান মেয়েকে ধর্ষণ করে যত না লাভ, তার চেয়ে বেশি লাভ মুসলমানদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিলে, তাদের ফসল নষ্ট করলে, তাদের গবাদিপশু চুরি করলে, জমিজমা জোর করে দখল করে নিলে, মেরে ফেলার হুমকি দিলে, ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করলে, মেরে ফেললে। মুসলমানরাও পুরুষতান্ত্রিক, তারাও তাদের কন্যাসন্তান ধর্ষিত হলে বা খুন হলে অতটা ভেঙে পড়ে না, যতটা ভেঙে পড়ে তাদের পুত্রসন্তান খুন হলে। হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের ঘৃণা করে, সেটার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। ঘর ওয়াপসি করে মুসলমানকে হিন্দু বানানো, মারধর করে তাদের ‘জয় শ্রী রাম’ বলানো, গরু খাওয়ার অভিযোগ এনে মুসলমান নির্যাতন করা, লাভ জিহাদের অভিযোগে অথবা রাম নবমীর উত্তেজনায় মুসলমান হত্যা করা। এসব কি মুসলমানদের প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের যে ঘৃণা, তার যথেষ্ট উদাহরণ নয়? একটি বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষকরা ধর্ষণ করেছে, এটাকেও সেই সাম্প্রদায়িক হিংসের তালিকায় ঢোকাতে হবে কেন? ধর্ষণ যারা করেছে তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক না হলেও ধর্ষকদের যারা সমর্থন করছে, তাদের উদ্দেশ্য নিশ্চিতই রাজনৈতিক। আসিফার পক্ষে যে অ্যাডভোকেট মহিলাটি লড়ছেন, তাকে যারা ধর্ষণ আর খুনের হুমকি দিচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যও রাজনৈতিক। ধর্ষণের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক নয় বলেই আমি মনে করি। ধর্ষণকে রাজনৈতিক বললে ধর্ষণকে একরকম গ্রহণযোগ্য করা হয়। কারণ রাজনৈতিক নানা কৌশলকে মানুষ কোনও না কোনওভাবে মেনে নেয়। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের ঝগড়া লড়াই, এমনকি খুনোখুনিটাও মেনে নেয়। ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নারী হত্যার বিরুদ্ধে, নারীবিদ্বেষের বিরুদ্ধে, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে যুদ্ধটা কোনও একটা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে করলে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হবে বটে, কিন্তু অসহায় মেয়েদের কোনও লাভ হবে না।
আসিফাকে ধর্ষণের পর খুন করেছে হাতেগোনা কিছু লোক। শত শত লোক আসিফার ধর্ষক আর খুনিদের বাঁচাতে চাইছে। কিন্তু লাখ লাখ লোক ধর্ষণ এবং খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, লাখ লাখ লোক ধর্ষক আর খুনিদের শাস্তি চাইছে। হয়তো প্রতিটি ধর্ষণের বিরুদ্ধে এমন জোর প্রতিবাদ হয় না, নির্ভয়ার ধর্ষণ এবং হত্যার বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে নয় শুধু, বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছিল। এবারও অনেকটা সেরকম হচ্ছে। যে মন্ত্রী ধর্ষকদের সমর্থনে হওয়া মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, চাপে পড়ে হলেও তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন। আসিফা নামের মুসলমান মেয়েটির পক্ষে যে পুলিশ হিন্দু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন, তিনি হিন্দু। যে মহিলা অ্যাডভোকেট আসিফার পক্ষে দাঁড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়ছেন, তিনিও একজন হিন্দু। ধর্ষণের প্রতিবাদে পথে নামছে যারা, তারা বেশির ভাগই হিন্দু। এত অগুনতি মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখে মনে হয় এখনো সমাজটা নষ্ট হয়ে যায়নি। ভারতের দোষ-ত্রুটি যেমন আছে, ভারতের মহত্ত্বও আছে। মন্দ লোক আছে জানি, ভালো লোকের সংখ্যা মন্দ লোকের চেয়ে অনেক বেশি। সাম্প্রদায়িক লোকের চেয়ে অসাম্প্রদায়িক লোকের সংখ্যা বেশি। বিশ্বাস করতে ভালো লাগে বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক লোকের চেয়ে অসাম্প্রদায়িক লোকের সংখ্যা বেশি। বিশ্বাস করতে ভালো লাগে একদিন এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান পারসি ইহুদি পাশাপাশি বাস করবে, কেউ কাউকে ঘৃণা করবে না, বরং মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করবে। ধর্ম কারও পরিচয় হবে না, সহনশীলতা হবে পরিচয়। একদিন নারী তার প্রাপ্য সমানাধিকার পাবে, পুরুষতন্ত্র বিদেয় হবে, নারীবিদ্বেষ দূর হবে, কোনও মেয়েই আর ধর্ষণের শিকার হবে না। সেদিন আমি, আপনি কেউ বেঁচে না থাকতে পারি, আমাদের মনুষ্য-প্রজাতিকে বাঁচানোর জন্য এমন একটি সুস্থ সুন্দর সমতার সমাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মই গড়ে তুলবে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন