রাজনীতিতে ‘কথার লড়াই’
বিভুরঞ্জন সরকার-বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন চলছে কথার লড়াই। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতারা প্রতিদিন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রাখছেন। রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে না গিয়ে তারা লড়ছেন ছায়ার সঙ্গে। বিএনপির কোনও নেতা একটি বক্তব্য দিলে আওয়ামী লীগের কেউ না কেউ তার জবাব দেবেন। আবার আওয়ামী লীগের কোনও নেতা বক্তব্য দিলে পাল্টা বলবেন বিএনপির কেউ। কথার শেষ নেই। নতুন কথা যে খুব বলা হয় তা-ও নয়। একই কথা বারবার বলে মানুষের মনে বিরক্তির উদ্রেক করা ছাড়া আর কিছু হয় বলে মনে হয় না। তবু কথামালার রাজনীতিই দেশে চলছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে দুই দলের বিতর্ক শেষ না হতেই সামনে এসেছে তারেক রহমানের পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব প্রসঙ্গ। নানা ইস্যু সামনে এনে বিএনপিকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কৌশল সরকার নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিএনপি এখন সরকারের দেখানো পথেই পা ফেলে অগ্রসর হচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বিএনপি নেতারা মাঝে-মধ্যে বলেন বটে কিন্তু মাঠের আন্দোলনের কোনও প্রস্তুতি তাদের নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে বিরোধী দলের সরকারকে চাপে রাখার কথা। আমাদের দেশে এখন ঘটছে উল্টোটা। সরকারই বিরোধী দলকে চাপে রেখেছে। সাঁতার না জানা মানুষ গভীর পানিতে পড়লে যেভাবে হাবুডুবু খেতে থাকে এবং কোনও রকমে নাক উঁচিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে, বিএনপির বর্তমান অবস্থা ঠিক তেমন। মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব আছে, সরকারি দলের একশ্রেণির নেতাকর্মীর বাড়াবাড়িতে অনেক জায়গায় মানুষ বিক্ষুব্ধ। কিন্তু বিএনপি এসব কাজে লাগাতে পারছে না। অতীতে একাধিকবার ভুল রাজনৈতিক কৌশল ও সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি এখন একটি দুর্বিপাকের মধ্যে আছে। বিএনপি’র প্রতি মানুষের আস্থা না থাকার কারণেই তাদের ডাকে মানুষ সাড়া দেয় না। এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করছে সরকার।
এ বছরের শেষে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে নির্বাচনে পরাজিত না হলে আওয়ামী লীগই আবার সরকার গঠন করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ভোটে হারাতে হলে যে জনপ্রিয়তা অর্জন করা দরকার বিএনপি সেটা করতে পারছে না। মানুষের সরকারবিরোধী মনোভাবকে ভোটে রূপান্তর করার জন্য যে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক উদ্যোগ ও কার্যক্রম থাকা দরকার সেটাও বিএনপির নেই। সরকারের দমন-পীড়নের অভিযোগ করা ছাড়া বিএনপির কোনও কাজ নেই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতকে শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশ বলা হয়। সেখানে কি সরকার বিরোধী দলকে কোনো না কোনোভাবে পীড়নের মধ্যে রাখা হয় না?তবে সেখানে বিএনপির মতো বিরোধী দল নেই। ভারতে বিএনপির মতো বিরোধী দল অর্থাৎ জ্বালাও-পোড়াও করা দল থাকলে সেখানকার সরকার কতটুকু সহনশীলতা দেখাতো তা বলা মুশকিল। বিএনপি এখন যে সভা-সমাবেশ করার অবাধ অধিকার পাচ্ছে না তার জন্য তাদের দায়ই বেশি। আবার এটাও ঠিক যে সরকার যেভাবে প্রতি ক্ষেত্রে বিএনপির ওপর কঠোরতা দেখাচ্ছে সেটাও সমর্থনযোগ্য নয়। শক্তি প্রয়োগ করে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। যে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রাখছে তা দূর করার প্রকৃত উদ্যোগ নিলেই বিএনপিকে দুর্বল করা সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে কোনও তফাত নেই– এই ধারণা যতদিন মানুষের মধ্যে থাকবে ততদিন বিএনপিও থাকবে। এটা সরকার তথা আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে। বিএনপি দাবি করে আসছে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মানুষ তাদের ভোট দেবে। মানুষের প্রতি বিএনপির আস্থা থাকলে তাদের উচিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া। জনসমর্থন না থাকলে কেবল কারচুপি করে ভোটে জেতা যায় না। নির্বাচনে কারচুপি করতে হলেও শক্তি-সামর্থ্য থাকতে হয়। এখানে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইয়াহিয়া খানের লিগাল ফ্রেমওয়ার্কের অধীনেও বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এই বিশ্বাস থেকে যে মানুষ ভোট দিতে ভুল করবে না।
যতদিন সক্ষম ও জীবিত থাকবেন ততদিনই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকবেন বা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন– এ ধরনের বাগাড়ম্বর করা কি খুব জরুরি ছিল? এসব কথা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের আস্থা ও সমর্থন থাকলে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে এটা বলা আর যতদিন শেখ হাসিনা সক্ষম ও জীবিত থাকবেন ততদিন ক্ষমতায় থাকবেন বলার মানে কি এক? আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তারা বিনাভোটে বা নামকাওয়াস্তে ভোটে ক্ষমতায় যেতে ও থাকতে চায়। হানিফ সাহেবের বক্তব্য কি ওই অভিযোগের পক্ষেই যুক্তি তুলে ধরবে না?মাহবুব-উল হানিফ আরো বলেছেন, ‘এদেশের জনগণ খালেদা জিয়া ও তার দুর্নীতিবাজ ছেলের নেতৃ ত্বে হত্যা-সন্ত্রাসের রাজনীতি দেখতে চায় না। তাই ২০১৮ সাল কিংবা ১০২৪ সসল নয়; ২০২৯ সালের পর বিএনপিকে ক্ষমতায় আসার জন্য চিন্তাভাবনা করতে হবে’। এই হিসাবের ভিত্তি কী? এটা কি আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা? তারা কমপক্ষে আরো দশ বছর ক্ষমতায় থাকবে, তারপর বিএনপিকে সুযোগ দেবে? এ রকম হাল্কা মন্তব্য দলের জন্য যেমন কোনও উপকারে আসবে না, তেমনি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেও সহায়ক হবে না। আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতির চালকের আসনে আছে, দায়িত্বশীল পদে থেকে ভুলভাল মন্তব্য করে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা এখন নিষ্প্রয়োজন। লেখক: কলামিস্ট