বাবা-মা ও বোনকে নিয়ে সিরিয়া যেতে চেয়েছিল নব্য জেএমবির নিলয়
সিটিটিসির উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘নিলয় দুর্ধর্ষ এক জঙ্গি। সে সর্বশেষ নব্য জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। সে তার পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে সিরিয়া যেতে চেয়েছিল। আমরা তাকে কয়েক দফা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তার কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা যাচাই-বাছাই করে তার পুরো নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলছে।’
সিটিটিসি সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২২ মার্চ বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকা থেকে নব্য জেএমবির আরেক শীর্ষ নেতা হাদিসুর রহমান সাগরসহ আকরাম হোসেন নিলয়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে গত বছরের ১১ নভেম্বর গুলশান এলাকা থেকে নিলয়ের বাবা আবু তোরাব এবং মা সাদিয়া হোসনা লাকি ও বোন তাজরীন খানম শুভ্রকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা জানান, নিলয়কে গ্রেফতারের পর তিন দফায় ১৩ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে নিলয় জানিয়েছে, সে ঢাকার স্কলাস্টিকা এবং ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল সম্পন্ন করে। এরপর সে মালয়েশিয়ার লিংকন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যায়। ২০১২-২০১৩ সালে গুলশানের আজাদ মসজিদে ‘ইতিকাফ করতে গিয়ে তার এক নাইজেরিয়ান নাগরিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওয়াহাব নামে ওই নাইজেরিয়ান নাগরিকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের প্রাথমিক দীক্ষা নেয় নিলয়। ঢাকায় পড়তে আসা ওয়াহাব পরবর্তীতে লিবিয়া গিয়ে জিহাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছে বলেও নিলয়ের ভাষ্য। নিলয়কে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০১২-১৩ সালের আগে নিলয় এত বেশি ধর্মকর্ম পালন করতো না। এমনকি সে নিয়মিত গাঁজা ও ইয়াবা সেবনও করতো। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়। ২০১২ সালে রমজান মাসে মাদক সেবন ছেড়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করে সে। পাশাপাশি গুলশানের আজাদ মসজিদে নিয়মিত ইতিকাফ করতো। সে সময় নাইজেরিয়ান নাগরিক ওয়াহাব তাকে জিহাদের পথে ডাক দেয়। এরপর থেকেই নিলয় কট্টরভাবে ইসলামি নিয়ম-কানুন পালন করা শুরু করে। এমনকি ধীরে ধীরে বাবা-মা ও বোনকেও একই পথে নিয়ে আসে। সিটিটিসির সূত্র বলছে, নিলয় ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ার লিংকন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েছিল। মালয়েশিয়ায় গিয়ে তার নিবরাসের সঙ্গেও পরিচয় হয়। ইতোমধ্যে সিরিয়ায় আইএসের হয়ে জিহাদি সংগ্রহের জন্য ঢাকায় যে নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল তাদের অনেকের সঙ্গে যুক্ত হয় সে। বিশেষ করে বছর দুয়েক আগে সিরিয়ায় চলে যাওয়া জোনায়েদ খান ও জুন্নুন শিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার। পরবর্তীতে তাদের হাত ধরেই নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয় সে। এমনকি নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরীর আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করতে থাকে। তবে দেশে জিহাদ করার চেয়ে পুরো পরিবার নিয়ে সিরিয়ায় চলে যাওয়ার বেশি ঝোঁক ছিল তার। ঢাকার পাকিস্তান, তার্কিশ ও ইরান দূতাবাসে ভিসার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয় নিলয়। পরে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে অবৈধভাবে দালালের মাধ্যমে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে সে। সিটিটিসি কর্মকর্তাদের নিলয় জানিয়েছে, সে প্রথমে কলকাতায় গিয়ে একটি সস্তা হোটেলে অবস্থান করে। পরবর্তীতে সে দালাল ও ভারতে অবস্থান করা নব্য জেএমবি সদস্যদের মাধ্যমে আঁধার কার্ড (ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র) তৈরি করে। ওই পরিচয়পত্র দিয়ে সে পাসপোর্ট তৈরির চেষ্টা করছিল। পাসপোর্ট তৈরির জন্য সে এক দালালকে বেশ কিছু টাকাও দিয়েছিল। নিলয়ের ইচ্ছে ছিল ভারত থেকে ইরান বা তুরস্কে যাবে। অথবা লিবিয়ায় গিয়ে সিনাই পর্বতমালা হয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে যেকোনও মূল্যে পাকিস্তান প্রবেশ করবে। সেখান থেকে আফগানিস্তানের খোরাসান হয়ে সিরিয়া যাবে। নিলয়ের ভাষ্য, গত বছরের নভেম্বরে দিল্লিতে তার এক সহযোগী ভারতীয় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সে সময় নিলয়ও দিল্লিতে অবস্থান করছিল। তার বাবা-মা ও বোনও চিকিৎসার নামে দিল্লিতে গিয়েছিল। নিলয়ের সহযোগী ধরা পড়ার পর সে নভেম্বরের শেষের দিকে অবৈধভাবে আবার দেশে চলে আসে। এরপর আত্মগোপনে থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল সে।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারের পর তারা নিলয়ের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো পরীক্ষা করে অনেক তথ্য পেয়েছেন। নব্য জেএমবির নিজস্ব যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রাম চ্যানেলে নিলয়ের পরিচয় ছিল ‘জ্যাক স্প্যারো’, ‘স্লেড উইলসন’ ও ‘ব্রুস ওয়েনে’ নামে। বাবা-মা ও বোনকে জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর নিলয়ের বোন শুভ্র নব্য জেএমবির সিস্টার উইংয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। নভেম্বরে শুভ্র গ্রেফতার হওয়ার পর এই দায়িত্ব দেওয়া হয় হুমায়ারা নামে এক নারীকে। তানভীর ইয়াসিন করিম নামে গ্রেফতার হওয়া আরেক জঙ্গির স্ত্রী হুমায়ারাকে সম্প্রতি পান্থপথের ওলিও হোটেলে বিস্ফোরণের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, নিলয় এমনভাবে জঙ্গিবাদে মোটিভেটেড হয়েছে, তার কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটন করা অনেক কঠিন। তার সঙ্গে দেশের ভেতরে এবং সিরিয়ায় যাওয়া অনেক বাংলাদেশি তরুণের যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু কিছুতেই তার কাছ থেকে সেসব তথ্য আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্রেফতারের পর প্রথম দিন আদালতে গিয়েই সে বিচারককে, তার ভাষায় ‘কুফরি রাষ্ট্র মানে না’ জানিয়ে রিমান্ড বা জেল যা ইচ্ছা রায় দেওয়ার আহ্বান জানায়। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদেও সে তাকে ‘হত্যা’র আহ্বান জানায়। তাতে অতি দ্রুত সে কথিত জিহাদের নামে বেহেশতে যেতে পারবে বলে মনে করে। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, এরকম ‘হাইলি মোটিভেটেড’ একজন জঙ্গির কাছ থেকে তথ্য আদায় করা অনেক কঠিন। তবু তাকে আবারও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।