ইব্রাহিম খলিল- চট্টগ্রাম মহানগরীর সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিন (১৫) হত্যাকাণ্ডে প্রেমিক আদনানসহ সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে এ ঘটনার তদন্ত নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা রহস্য। বুধবার সকালে  চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার ১৮ নম্বর ব্রিজের উত্তর পাশে পাথরের উপর  থেকে তাসফিয়ার মুখ থেঁতলানো রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় তার মুখে ফেনা ছিল বলে জানান পতেঙ্গা থানার এসআই মনিরুল ইসলাম। লাশ উদ্ধারের পর তাসফিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হতে পারে এমন কথা বললেও পুলিশ পরে তা হত্যা না আত্মহত্যা তা ফরেনসিক রিপোর্টের আগে বলা সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছে। তবে এর আগে তাসফিয়ার বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ মঙ্গলবার রাতে আদনান মির্জাকে আটক করে নিয়ে যায়। করা হয় জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু পরে আদনানের সন্ত্রাসী দুই বড়ভাই ফিরোজ ও আকরাম তাসফিয়াকে বাসায় পাঠানোর শর্তে আদনানকে ছাড়িয়ে নেন। ফিরোজ ও আকরাম বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী নেতার সহযোগী। আদনানও স্থানীয় কিশোর গ্যাং এর নেতা।  এদিকে তাসফিয়ার লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ বুধবার দিনগত মধ্যরাতে আদনান মির্জাকে গ্রেপ্তার ও তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জব্দ করে। তবে আদনান মির্জার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করছে না পুলিশ।  এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কর্ণফুলী জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে আদনান মির্জা বলেছে, নগরীর চায়না গ্রিল থেকে তাসফিয়াকে বাসায় যেতে সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দেয়ার পর তার আর কিছুই জানা নেই। তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উন্মোচনে আমরা চার ধরনের থিওরি নিয়ে এগুচ্ছি। এরমধ্যে চায়না গ্রিল থেকে তাসফিয়া কিভাবে কার সাথে পতেঙ্গা নেভালে গেল। আদনান মির্জার সাথে থাকা তার বন্ধুরাই বা নিখোঁজ কেন? আর তাসফিয়ার লাশ একদিন পরই বা পাওয়া গেল কেন। তাহলে মঙ্গলবার সারারাত তাসফিয়া কোথায় ছিল। নাকি আদনান মির্জাকে ফাঁসাতে তৃতীয় কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
জাহেদুল ইসলাম আরও বলেন, আদনান মির্জা বাংলাদেশ অ্যালিমেন্টারি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র এবং ব্যবসায়ী ইস্কান্দার মির্জার ছেলে। থাকে দক্ষিণ খুলশী জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি এলাকায়। তাদের গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়ার পদুয়া ইউনিয়নে।
আর তাসফিয়ার বাবা আমিন উদ্দিন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী। তাদের গ্রামের বাড়ি টেকনাফ থানার ডেইল পাড়ার কালা মোহাম্মদ আলি বাড়ি। নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির এক নম্বর সড়কে অবস্থিত সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণীতে পড়তো তাসফিয়া।
পুলিশ জানায়, ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে মাত্র এক মাস পূর্বে আদনানের সঙ্গে প্রেমের সমপর্ক গড়ে উঠে তাসফিয়ার। ফেসবুক ও ইমোতে ম্যাসেজ আদান-প্রদানে বিষয়টি টের পান তাসফিয়ার মা। তাসফিয়ার বাবা আমিন বিষয়টি জানার পর আদনানকে ডেকে শাসিয়ে দেন। মেয়ের পথ থেকে সরে যেতে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেন। এ ঘটনার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নগরীর ও আর নিজাম রোডের গোল পাহাড় মোড়ে চায়না গ্রিল নামে একটি রেস্টুরেন্টে মিলিত হয় তাসফিয়া ও আদনান। সেখানে প্রায় ২০ মিনিট অবস্থান করে তারা দুজন। এ সময় আদনান মির্জার তিন বন্ধু বাইরে অবস্থান করে।
রেস্টুরেন্টের বয় উজ্জ্বল জানান, মঙ্গলবার ৫টা ২০ মিনিটের দিকে রেস্টুরেন্টে আসে এক তরুণ-তরুণী যুগল। তারা রেস্টুরেন্টের ৮নং কেবিনে বসে। এরপর খাবার অর্ডার নিতে গেলে শুধুমাত্র ২টা আইসক্রিম অর্ডার করে তারা। প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট অবস্থানের পর সপ্তম তলার এই রেস্টুরেন্ট থেকে লিফটে একই সাথে নেমে যায় তারা। আদনানও স্বীকার করে একসাথে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কথা। এরপর তাসফিয়াকে আদনান সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দিয়েছিল বলেও জানায়। মঙ্গলবার বিকেল ৬টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ঘটনা আদনানের স্বীকারোক্তির সঙ্গে মিলেছে। সিসিটিভি ফুটেজও বলছে একই কথা। তবে এর পরের ঘটনা উল্টো। তাসফিয়ার বাবা নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন মঙ্গলবার। ফলে পুলিশ রাত সাড়ে ৯টার দিকে আদনানকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আদনানকে। সেখানে প্রায় দুই-দেড় ঘণ্টার মাথায় আদনানের দুই বড়ভাই ফিরোজ ও আকরাম তাসফিয়াকে বাসায় পাঠানোর শর্তে ছাড়িয়ে নেয় আদনানকে। কিন্তু পরদিন বুধবার সকালে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার ১৮ নম্বর ব্রিজের উত্তর পাশে পাথরের উপর  থেকে উদ্ধার করা হয় তাসফিয়ার লাশ।
এ ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার জানান, খবর পেয়ে মৃতদেহটি বুধবার সকালে উদ্ধার করা হয়। দুপুরের দিকে তাসফিয়াকে শনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা। এর আগে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি ও সিআইডি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। বিকেল ৫টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য। আনোয়ার জানান, তাসফিয়াকে পাথরের উপর উপুর হয়ে পড়ে থাকাবস্থায় পাওয়া গেছে। পরনে হালকা গোলাপি সালোয়ার কামিজ। গায়ের রঙ ফর্সা। তবে দুই চোখ ও হাঁটুতে হাল্কা আঘাতের চিহ্ন আছে। মুখের মধ্যে ফেনা ছিল। ধর্ষণ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে এই তদন্তকারী অফিসার জানান, সেটা সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে বলা যাবে। সে ব্যাপারে সিআইডি তাদের প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করেছে। এছাড়া তাসফিয়ার বয়ফ্রেন্ড আদনানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তার ৬ বন্ধুসহ তাকে আসামি করে মামলা নেয়া হয়েছে। তাসফিয়ার চাচা নুরুল আমিন জানান, তাসফিয়া পরিবারের সবার বড়। এরপর দুই বোন। সর্বকনিষ্ঠজন ভাই। তবে পরিবারের সদস্য ছাড়া তাসফিয়া কখনো একা বাসা থেকে বের হয়নি। গাড়ি নিয়েই স্কুলে আসা-যাওয়া করতো। সাথে মা, না হয় বাবা থাকতেন। এর মধ্যেও ফেসবুকে সমপর্ক হয়ে আজ এতো বড় ক্ষতি। তিনি বলেন, তাসফিয়া মঙ্গলবার বিকেলে কাউকে না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজির পর তাসফিয়াকে না পেয়ে তার বন্ধুদের কাছ থেকে আদনানের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেন বাবা। এরপর কল করে আনা হয় আদনানকে। তাকে নিয়ে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে চায়না গ্রিল রেস্টুরেন্টে যান তারা। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা করেন। এরপর থানায় অভিযোগ করা হয়।  

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn