হতাশ করলেন মির্জা সাহেব!
বিএনপি মহাসচিবের কাছে সাংবাদিক নবনীতা চৌধুরী বারবারই জানতে চাইছিলেন, এই মুহূর্তে বিএনপি আসলে কী চাইছে? তাদের তো অসংখ্য দাবি-দাওয়া, যা নিয়ে এতদিন ধরে তারা রাজপথে, সংবাদ সম্মেলনে দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সেগুলো পূরণ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নবনীতা চৌধুরীর ‘দশা’ শব্দটি নিয়ে বিএনপি মহাসচিব আপত্তি করেছেন। বলেছেন, সাংবাদিকরা এরকম শব্দ দিয়ে বিএনপি’কে যেভাবে চিত্রিত করতে চান সেটা ঠিক নয়। কিন্তু বিষয়টি যে সত্য, তাতে তো কোনও ভুল নেই। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে। তার মুক্তির আশু কোনও সম্ভাবনা নেই। গোপনে নির্বাচন কমিশনে প্রতিনিধি পাঠিয়ে দলের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে যাকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে তিনিও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিদেশে পলাতক অবস্থায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে আছেন। যে কারণে বেগম জিয়াকে চেয়ারপারসন না রেখে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন করা হয়েছে, সেই একই কারণে তারেক রহমানও এই পদের যোগ্য নন। ইতোমধ্যেই সরকারি দলের পক্ষ থেকে তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলা হয়েছে, বলা হচ্ছে তিনি স্বেচ্ছায় বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কোনওভাবেই বিএনপি’র অনুকূলে নয়। এমতাবস্থায় কোন দাবি নিয়ে বিএনপি অগ্রসর হবে? এরকম প্রশ্নে বারবারই বিএনপি মহাসচিব তাদের কৌশল বদলের কথা বললেন, বললেন পরিস্থিতি বা পরিবেশের কথা, সরকারের সমালোচনা করলেন, যা কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না কিন্তু তিনি একবারও প্রশ্নটির সরাসরি কোনও উত্তর দিলেন না। একপর্যায়ে তিনিও একটু বিরক্তি নিয়েই বললেন, আপাতত বেগম জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া বিএনপি আর কিছুই ভাবছে না। ফখরুল সাহেবের ভাষ্য অনুযায়ী, বেগম জিয়ার মতো গণতন্ত্রের জন্য আর কেউ কোনও ত্যাগ স্বীকার করেননি, তাকে বন্দি রেখে বিএনপি নির্বাচনে যায় কী করে? হাত-পা বেঁধে কাউকে পুকুরে ফেলে যদি বলা হয় সাঁতার কাটো তাহলে কি সাঁতার কাটা যায়? হাত-পা খুলে দিতে হবে আগে, আগে পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে নির্বাচনে যাবেন কী যাবেন না। পুরো সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিবের এই বক্তব্যটাই সবচেয়ে স্পষ্ট এবং আমরা প্রতিদিন যা জানি তার কাছ থেকে তাই আবার জানলাম, বিএনপি এই মুহূর্তে বেগম জিয়ার মুক্তি ছাড়া আর কোনও দাবি নিয়ে মাঠে নেই। জনজীবনের বাকি সকল সমস্যা বিএনপি’র কাছে গৌণ। রাষ্ট্রের বাকি সবকিছু একমাত্র বিএনপি নেত্রীর মুক্তির কাছে তুচ্ছ।
মজার ব্যাপার হলো, বিএনপি মহাসচিবের কথা থেকে কাল এটাও স্পষ্ট হলো,বেগম জিয়াকে কেবল মুক্তি দিলেই হবে না, তার ওপর থেকে সকল মামলা প্রত্যাহারও করতে হবে। সরকার চাইলেই সব পারে। একটি দেশের মৌলিক বিরোধী দলের মহাসচিবই যদি সরকারকে দিয়ে আইন-আদালতকে প্রভাবিত করে তাদের নেত্রীর মামলা তুলিয়ে নিতে চান তাহলে আমরা কি এটাই ধরে নেবো, আইন-আদালতকে নিজের পক্ষে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিএনপি মহাসচিবের কোনও আপত্তি নেই, কেবল সরকার যদি তাদের পক্ষে ব্যবহার করে তাহলেই শুধু এদেশে আইন নেই, বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে বলে চিৎকার শুনতে হবে আমাদের? বিএনপি মহাসচিব খুব সুন্দর করে কালকে আমাদের এই জরুরি কথাটিও বুঝিয়ে দিয়েছেন, সরকার চাইলে সব পারে, তার মানে তাদের দলটি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা যা চাইতেন তাই করতেন; এই সত্যও কালকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হলো।
আমরা ২০১৬ সালে শুনেছিলাম যে যথাসময়ে বিএনপি একটি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে। বহুবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন মির্জা সাহেবসহ বিএনপির অন্যান্য নেতা। কিন্তু দেশ আরেকটি নির্বাচনের মুখোমুখি প্রায়, নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে অক্টোবর নাগাদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এখনও বিএনপি একটি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দিতে পারেনি। এ নিয়ে তাদের দলীয় ফোরামে কোথাও আলোচনার কথাও আমরা জানি না। প্রশ্ন করা হলে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খুব সহজভাবেই হয়তো গণমাধ্যমের ওপর দোষ চাপাবেন যে তারা কোনও কিছু না জেনেই সংবাদ পরিবেশন করে, যেমনটি তিনি কাল সাক্ষাৎকারে বলেছেন। আমরা একথা কোনও রকম রাজনীতি না করেই জানি যে কোনও দাবি নিয়ে রাজনৈতিক দলকে প্রথমে সেটা জনসম্মুখে উপস্থাপন করতে হয়, তারপর সেটিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বারবার জনগণের সামনে সে দাবিকে উচ্চারণ করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার কথাই যদি ধরি তাহলে তার ইতিহাস বলে, প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা উত্থাপন করেন এবং তারপর পূর্ব পাকিস্তানে এই দাবিনামা নিয়ে তিনি পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে তার ভিত্তিতেই একটি নির্বাচন করেন অর্থাৎ নির্বাচনি ইশতেহারেও ছয় দফার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল মনে করছে, তারা যেকোনও সময় একটি রূপরেখা দিয়ে বলবেন মেনে নেওয়া হোক আর অমনি তা মেনে নিতে সরকার ও জনগণ বাধ্য থাকিবে। এদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে এরকম কোনও ঘটনা আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই।
বিএনপি মহাসচিবের সাক্ষাৎকার থেকে এই প্রশ্নটির উত্তর জানার জন্য খুব অধীর হয়ে ছিলাম যে বিএনপি’র ভবিষ্যৎ রাজনীতিটি আসলে কী? কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানটিতেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সে বিষয়ে কোনও ইঙ্গিত দেননি, অন্ততপক্ষে আমি পাইনি। তবে পুরো আলোচনা থেকে এটা মনে হয়েছে, একমাত্র আওয়ামী লীগ যদি বিএনপি’র কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনি প্রস্তাব নিয়ে এসে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আলোচনায় ডাকেন তবেই কেবল তিনি গিয়ে তাতে অংশ নেবেন এবং দেশে তখনই কেবল গণতন্ত্রের বান ডাকবে, তার আগ পর্যন্ত মির্জা ফখরুলের মতে সবকিছু অন্ধকারে নিমজ্জিত। এমনকি তিনি যে টেলিভিশন চ্যানেলে বসে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন সেটিও (দেশের গণমাধ্যমও) সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কি সেরকম কিছু চাইবে? বা আওয়ামী লীগ এরকম কিছু কেন চাইবে?
বিএনপি বহুদিন ধরেই বলে আসছে হয় রমজান নয় ঈদের পরে সর্বাত্মক আন্দোলন হবে এবং তার মাধ্যমে তারা সরকারের পতন ঘটাবে। এরমধ্যে বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে শাস্তি ঘোষিত হলো, তিনি কারাগারে গেলেন। আরো কিছু মামলা শেষের পর্যায়ে রয়েছে। আর একাধিক মামলায় তাকে কখনও গ্রেফতার, কখনও জামিন দেওয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় দলের সাধারণ নেতাকর্মী বা সমর্থকদের জন্য বিএনপির মতো দলের পক্ষ থেকে কোনও সুসংগঠিত রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই সেটা যে বিএনপি’র কর্মী বা সমর্থকদের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক সেটা নিশ্চয়ই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বোঝেন। সরকার তাদের পরিবেশ/পরিস্থিতি করে দেয়নি সেটা বোধগম্য, তারাও আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের পরিবেশ/পরিস্থিতি তৈরি করে দিতেন বলে আমরা জানি না। এই মুহূর্তে বিএনপি রাজনীতির কঠিন ও বাস্তব সত্য হলো, দলটির দুই নেতা আদালতের নির্দেশে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে একজন দেশের কারাগারে, অপরজন বিদেশে পলাতক ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী, দলের ভেতর নেতৃত্ব পর্যায়ে কোন্দলের খবর এখন ‘ওপেন সিক্রেট’, যেকোনও মুহূর্তে দল ভাঙার খবর হেডলাইন হবে বলে মনে করেন কোনও কোনও বিশ্লেষক। এই পরিস্থিতিতেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে তার কবিতা থেকে দু’চরণ উদ্ধৃতি দিয়ে নেতাকর্মীদের মনোবল শক্ত করতে বলেন তখন বিএনপির রাজনৈতিক সুমতি হয়েছে বলে ধরে নিলেও একথা মনে পড়ে যায়, পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে সেই আন্দোলনে শক্তিক্ষয় না করলে হয়তো আজকে মির্জা সাহেবকে এই কবিতা আওড়াতে হতো না।
কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্নটি মাথায় আসে তখন যখন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি, মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। মির্জা সাহেব সত্যিই একটি সত্য কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কিন্তু এদেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল কে যেন? সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাজনৈতিক দল তৈরি করেছিল কোন জেনারেল? বিএনপি মহাসচিব হিসেবে তিনি এই প্রশ্নের উত্তর জানলেও দেবেন না হয়তো, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পঙক্তি আওড়ানো মির্জা ফখরুল ইসলামের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর আমরা দাবি করতেই পারি।লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি