লাঞ্ছিতকারীই প্রতারক-
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এর আগেও বন্ধ রাখা হয়েছিল নোবেল। কিন্তু যৌন কেলেংকারীর জন্য এই প্রথম। সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্যরা প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল দেওয়ার জন্য সাহিত্যিক নির্বাচন করেন। কিন্তু এ বছর তা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ ১৮ জন সদস্যের মধ্যে অ্যাকাডেমিতে এখন আছেনই মাত্র ১০ জন সদস্য। আরও বেশি সদস্যের অনুমোদন দরকার হয় পুরস্কার ঘোষণা করার জন্য। প্রশ্ন হলো, অ্যাকাডেমির বাকি সদস্যরা গেলেন কোথায়? উত্তর, পদত্যাগ করেছেন। কারণ অ্যাকাডেমির এক সদস্যের স্বামীর বিরুদ্ধে ১৮ জন মেয়ে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছেন। ওই স্বামীর গড়ে তোলা একটি সংগঠনের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি টাকা সাহায্য দিত। তা ছাড়াও স্বামীটি স্ত্রীর কাছ থেকে কোন সাহিত্যিক নোবেল পেতে যাচ্ছে জেনে নিয়ে তাঁর নাম ফাঁস করেছেন গত কয়েক বছর। এইসব অস্বস্তিকর ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর অ্যাকাডেমির কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করেন।
‘মী টু’ আন্দোলনের কারণেই সম্ভব হয়েছে মেয়েদের এগিয়ে এসে বিখ্যাত সেই স্বামীর কীর্তিকলাপ সম্পর্কে বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া। এই আন্দোলন যৌন নির্যাতনের শিকার যে মেয়েরা, তাদের মুখ খোলার, ভয় না করার, লজ্জা না পাওয়ার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছে। তাদের সাহসী করে তুলেছে। যত বড়, যত ধনী, যত প্রভাবশালীই হোন না কেন পুরুষ, তাঁদের যৌন হেনস্থার কথা আর গোপন থাকবে না। এবং তাদের ‘টাইম ইজ আপ’। মেয়েরা যদি যৌন হেনস্থার অভিযোগ না করতো, স্বামী জঁ-ক্লদ আর্নো মহান পুরুষ হিসেবেই সমাজে পরিচিত হতো। এখন লোকটির সুনাম ধুলোয় মিশে গেছে, লোকটি সুইডিশ অ্যাকাডেমি থেকে পাওয়া সুযোগ সুবিধে হারিয়েছেন, তাঁর কুকীর্তির কারণে তাঁর স্ত্রী সুইডিশ অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
হলিউডেও তোলপাড় হয়ে গেছে। প্রভাবশালী প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টেইনের বিরুদ্ধে এক এক করে নারীরা যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছেন। হার্ভিকে এরপর তাঁর কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কেভিন স্পেসি, বেন এফ্লেকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে। কেভিন স্পেসিকে তো নেটফ্লিক্স থেকে বের করে দেওয়া হলো। বেন এফ্লেক কোনও এক সময় কোনও এক সাংবাদিকের বুকে হাত দিয়েছিলেন, আজ তাঁকে তাঁর সেই অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছে। পরিচালক অলিভার স্টোনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ, বছর কুড়ি আগে কোনও এক পার্টিতে কোনও এক মহিলার স্তনে চাপ দিয়েছিলেন তিনি। সেই মহিলা আজ সে কথা ফাঁস করেছেন। ডাস্টিন হফম্যান, সিলভেস্টার স্ট্যালন, মাইকেল ডগ্লাস, রোমান পোলান্সকি, ডেভিড কপারফিল্ডসহ ১২২ জন বিখ্যাত লোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন মেয়ে। অনুমতি না নিয়ে কারো বুকে হাত দিয়েছেন ওরাঁ, কারো নিতম্বে হাত দিয়েছেন, কাউকে যৌন রসাত্মক কথা শুনিয়েছেন, কাউকে একা ডেকেছেন ঘরে, কাউকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন, কাউকে ধর্ষণও করেছেন। শুধু হলিউড নয়, সমাজের সর্বত্র— গানের জগত, ছবির জগত, রাজনীতির জগত, বাণিজ্যের জগত, মিডিয়ার জগত— সব জগতেই এই আন্দোলন চলছে। শুধু সাধারণ মেয়েই নয়, বিখ্যাত বিখ্যাত সব মেয়েও অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ করেছেন বিখ্যাত বিখ্যাত পুরুষদের বিরুদ্ধে। সেই বিখ্যাত বিখ্যাত পুরুষদের আরাম আয়েসে এখন ধস নেমেছে, সুনাম ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, চাকরি বাকরি চলে গেছে, ব্যবসা বাণিজ্যের সমাপ্তি ঘটে গেছে। সত্যি বলতে, এঁদের ভালোমানুষির মুখোশ খুলে দিয়েছে মী টু আন্দোলন।
‘মী টু’ আন্দোলনটি যত প্রবল হয়ে উঠেছে পশ্চিম দুনিয়ায়, তত প্রকাশিত হচ্ছে নারীবিদ্বেষের ব্যাপকতা। ‘টাইম’স আপ’ আন্দোলনও পাশাপাশি চলছে, ধসে পড়ছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রীরা পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইউরোপের কান চলচ্চিত্র উৎসবে এই প্রথম যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে হটলাইন রাখা হয়েছে। কেউ যৌন হেনস্থা করার পাঁয়তারা করলে হটলাইনে জানিয়ে দেওয়া হবে। কান উৎসবের টিকিট, নিমন্ত্রণ পত্র ইত্যাদিতে উপদেশ লিখে দেওয়া হয়েছে, ‘ভদ্র ব্যবহার করুন’, ‘পার্টি নষ্ট করবেন না, কাউকে হেনস্থা করবেন না’। কানের এই উদ্যোগ খুব প্রয়োজনীয় এবং প্রশংসনীয়। দু’দিন আগে নিউইয়র্কের এটর্নি জেনারেল এরিক স্নাইডারম্যান পদত্যাগ করেছেন, কারণ তাঁর চারজন পুরোনো প্রেমিকা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের মারধর করতেন এরিক। এরিক যদিও মুখে নারী স্বাধীনতার কথা প্রচুর বলতেন, কিন্তু তাঁকে মিথ্যেবাদী হিসেবেই, প্রতারক হিসেবেই লোকে এখন বিচার করছে, লজ্জায় তিনি তাঁর পদ থেকে নেমে গেছেন। পাশ্চাত্যে যৌন হেনস্থার বা অত্যাচারের অভিযোগ উঠলে অতি উঁচু পদাধিকারীকেও, অতি বড় প্রভাবশালীকেও অপমানিত আর অপদস্থ হতে হয়, ধিকৃত হতে হয়। নিজের উঁচু পদ থেকে মাথা নিচু করে বিদায় নিতে হয়। তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মুখে চুন কালি পড়ে। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের কী হাল? এখনও মেয়েরা অকথ্য নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। শুধু প্রাপ্ত বয়স্কাই নয়, অবুঝ শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। প্রতিদিনই কোনও না কোনও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, আজ কুমিল্লায়, কাল কলকাতায়। ভারতের কথাই ধরি, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও অভিযুক্তদের সুনাম নষ্ট হয় না। ১৯৮৮ সালে পাঞ্জাবের পুলিশের তখনকার ডিজিপি কেপিএস গিলের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলেন সরকারি এক কর্মচারী। পরের বছরই কেপিএস গিলকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার দেওয়া হয়। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও গিলের পদ্মশ্রী ফেরত নেওয়া হয়নি, তাঁর সুনামেও কোনও আঁচড় পড়েনি। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৪৮ জন বিধায়ক এবং ৩ জন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণ-সহ নানা নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এতে দলের কারো কিছু যায় আসে না। প্রয়োজনে মেয়েদের কাপড় চোপড়ের আর চরিত্রের দোষ দিয়ে ধর্ষণের পক্ষে মত দেবে তারা। এর ফলে কাউকে কোনও দুর্ভোগ পোহাতে হবে না, কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষই যৌন নির্যাতনের শিকারকে দোষ দিয়েই অভ্যস্ত, শিকারীকে নয়।
নারীবিদ্বেষ, নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ আমাদের সমাজে এতই স্বাভাবিক যে পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সমাজ পুরুষের দিকে নয়, নারীর দিকে ঘৃণা ছোঁড়ে। পুরুষকে মাথা নিচু করতে হয় না, নারীকে করতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যে পুরুষই আমাকে লাঞ্ছিত করেছে, যে পুরুষই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, তাদের কাউকে অপদস্থ করেনি সমাজ, করেছে আমাকে। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে এক কালে আমার সম্পর্ক ছিল প্রেমের এবং বিয়ের। সে কিভাবে আমাকে প্রতারণা করেছে, তা আমি আমার আত্মজীবনীর ২য় খন্ড ‘উতল হাওয়া’য় বলেছি। বিয়ের পরও তাঁর নিয়মিত গণিকালয় গমন এবং যৌন রোগ বহন করে নিয়ে এসে নিজের স্ত্রীকে সংক্রামিত করার ভয়াবহ সেইসব কাহিনী। সেসব পড়ার পর বাংলাদেশের সমাজ রুদ্রকে এতটুকু ঘৃণা করেনি, করেছে আমাকে। কেন আমি যৌন বিষয় আশয় নিয়ে মুখ খুলেছি, নিশ্চয়ই আমি খারাপ, নিশ্চয়ই আমি ‘পতিতা’। কারণ তাদের কাছে যে মেয়ে মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে, সে মেয়ে ভালো।
যে মেয়ে স্বামীর কোনও অপকর্মকে প্রকাশ না করে লুকিয়ে রাখে, সে মেয়ের চরিত্র চমৎকার। আসলে রুদ্রের কীর্তি ফাঁস হওয়ার পর রুদ্রের বদনাম হয়নি বরং তার জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বেড়েছে। কোনও সভ্য দেশে এটি কল্পনা করা যায় না। আত্মজীবনীর তৃতীয় খন্ড ‘দ্বিখন্ডিত’তে লিখেছি, দেশের বড় সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক আমাকে বলতেন তাঁর সঙ্গে কোন কোন কচি মেয়ের কী কী সম্পর্ক। আমাকেও একবার দূরে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে এক ঘরে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও আমি মন্দ কিছুই ঘটতে দিইনি, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ অস্বস্তি দিয়েছিল। এই সত্য যখন প্রকাশ করেছি, তখন সৈয়দ শামসুল হককে কি ক্ষমা চাইতে হয়েছে? তাঁকে কি মাথা নত করতে হয়েছে? তাঁর সামাজিক প্রতিষ্ঠা কি সামান্যও নড়েছে? না। তিনি বরং মাথা উঁচু করে মিথ্যেচার করেছেন, কোর্টে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মামলা করেছেন, হাইকোর্টকে দিয়ে আমার বই নিষিদ্ধ করিয়েছেন। সৈয়দ হক নেই, কিন্তু আমার বইটি আজও নিষিদ্ধ। বাক স্বাধীনতার পক্ষে, নারী স্বাধীনতার পক্ষে যাদের থাকার কথা, তারা সবাই সৈয়দ হককে মহান বলেছে, আর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করেছে আমাকে। কারণ আমি মহান লোকটির কুকর্মের কথা ফাঁস করে দিয়েছি।
এই হল আমাদের পচা পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী সমাজ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার আমার বুকে হাত দিয়েছিলেন। আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর আচরণ দেখে। ওই কথা জানাবার পরও কেউ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ছি ছি করেনি, করেছে আমাকে। আমার দ্বিখন্ডিত বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য যখন উঠে পড়ে লেগেছিলেন সুনীল, বলেছিলেন দুজন মানুষের মধ্যে দরজা বন্ধ থাকা অবস্থায় কী ঘটে, তা কোনও দিন বাইরে জানাতে হয় না। যেহেতু দ্বিখন্ডিততে আমি তা জানিয়েছি, অপরাধী আমি। আর যে পুরুষেরা অপরাধ করেছে, তারা অপরাধী নয়, কারণ তারা পুরুষ। সুনীল এই মী টু আন্দোলন দেখলে কী বলতেন? পাশ্চাত্যের যে মেয়েরা, বিখ্যাত সব পুরুষেরা দরজা বন্ধ করে কী ঘটনা ঘটিয়েছিল, সেগুলো ফাঁস করে দিচ্ছে,— তাদের কি গালাগালি করতেন? না করতেন না। পাশ্চাত্যের মেয়ে বলে তাদের বাহবা দিতেন, আর দেশি মেয়ে একই কাজ করলে তাঁর মুখ বন্ধ করার জন্য, তাকে রাজ্য থেকে তাড়াবার জন্য যা করার তাই করাকে যৌক্তিক মনে করতেন!
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন