কামরুল হাসান দর্পণ : একটা সময় ‘দেয়াল লিখনে’ মানুষের আবেগ-অনুভূতি, অনিয়ম-দুর্নীতি, অপশাসনের প্রতিবাদ ও ক্ষোভ ফুটে উঠত। রাজনৈতিক দল থেকে সচেতন ব্যক্তিবর্গকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে শোনা যেত, ‘দেয়ালের লিখন পড়–ন। জনগণ কী বলতে চায়, বুঝুন।’ কালের বিবর্তনে প্রযুক্তির উৎকর্ষে ‘দেয়াল লিখন’ এখন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম-ব্লগ, টুইটার, ফেসবুকে ঠাঁই করে নিয়েছে। সচেতন মানুষ তাদের মনের কথা এসব মাধ্যমে প্রকাশ করে, তর্ক-বির্তকের ঝড় তোলে। সরকার ও বিরোধী দলের তুমুল সমালোচনা করে। এসব মাধ্যমের একটা অসুবিধা হচ্ছে, যারা ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ নন, তাদের পক্ষে এসব সমালোচনা জানা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে এ কথাও সত্য, প্রযুক্তির উৎকর্ষ অস্বীকারের উপায় নেই। কোন একসময় হয়ত বাংলাদেশের সকল মানুষ প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের মনের বাদ-প্রতিবাদ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সরকার ও বিরোধী দলের কর্মকান্ডের সমালোচনা করতে পারবে। মুশকিল হচ্ছে, এখন যারা সামাজিক মাধ্যমে মুক্তভাবে সরকার ও বিরোধী দলের সমালোচনা করেন, তারা যে পুরোপুরি স্বাধীন, এ কথা বলা যাবে না। বিশেষ করে ইন্টারনেটের ‘সফট ওয়ালে’ কঠিন কথা বলে সরকারের সমালোচনা করলে বিপদে পড়তে হয়। এ ধরনের ঘটনায় অনেককে ইতোমধ্যে জেলে যেতে হয়েছে। অর্থাৎ কনক্রিটের দেয়ালের চেয়েও ইন্টারনেটের ‘সফট ওয়াল’ শক্তিশালী এবং সরকারের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। ফলে সরকার বিরোধী সমালোচনা নিয়ন্ত্রণে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইননে একটি ধারা সংযুক্ত করেছে যা ৩২ ধারা নামে পরিচিত। ধরাটি ‘ফ্রিডম অব স্পিস’-এর পরিপন্থী এবং কালো আইন বলে পত্র-পত্রিকাসহ সর্বত্র ইতোমধ্যে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তবে একটা কথা না বললেই নয়, প্রযুক্তির যেমন সুফল আছে, তেমনি কুফলও আছে। সামাজিক মাধ্যমটি আমাদের দেশের একটি শ্রেণীর কাছে অনেকটা শিশুকে আগুন নিয়ে খেলতে দেয়ার মতো হয়ে গিয়েছে। তারা শালীনতা বিবর্জিত এবং অকথ্য কথা, ভিডিও লিখে বা আপলোড করে মনের খেদ মিটানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণ জরুরী। আবার গুটিকয় ব্যক্তির কারণে সচেতন শ্রেণীর মত প্রকাশের পথ বন্ধ করে দেয়াও সমর্থনযোগ্য নয়। দেখা যাচ্ছে, সরকারের সমালোচনা করলে এবং তা যদি সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়, তবে তাকে এই আইনে সহজেই গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারের অসহিষ্ণুতাই ফুটে উঠেছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সরকারের সমালোচনা এবং ত্রæটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার বিষয়টি অলংকার হিসেবে পরিগণিত হয়। এসব সমালোচনা সরকারকে ধৈর্য্য সহকারে সহ্য করতে হয়। এটা গণতান্ত্রিক বিশ্বে স্বীকৃত। আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। জর্জ বুশ যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন আমেরিকায় একটি জরিপের ফলাফলে বেশিরভাগ আমেরিকান তাকে ‘গাধা’ বলে উল্লেখ করেছিল। এ সংবাদ বুশের কান পর্যন্ত যায়। তাতে তিনি কিছু মনে করেননি। আমাদের দেশে যদি এ ধরনের জরিপ প্রকাশ করা হতো তবে জরিপকারী প্রতিষ্ঠান তো বটেই যত মানুষ এমন মন্তব্য করেছে তাদের খুঁজে বের করে জেলে ঢুকানো হতো। তবে ইন্টারনেটের ‘সফট ওয়ালে’ সচেতন মানুষের কঠিন কথায় বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সরকারের মনঃপুত না হলে সমালোচনাকারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্রই হচ্ছে, যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য সমালোচনা হলে, তা সরকারবিরোধী না ভেবে ইতিবাচকভাবে দেখা। আমাদের দেশে প্রায়ই এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়।
দুই.
নব্বই দশকের মাঝামাঝি রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে ‘কষ্টে আছে আইজউদ্দিন’ নামে একটি লেখা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আইজউদ্দিন নামে কোন এক ব্যক্তি যে কষ্টে আছে এবং তার এই কষ্টের কথা যে সবাইকে জানানো প্রয়োজন, তা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সে দেয়াল বেছে নিয়েছিল। লেখাটি অনেকের মনে দাগ কেটেছিল। টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাকে হাজির করে তার কষ্টের কথা মানুষকে শোনানো হয়েছিল। সহানুভূতি প্রকাশ করে তখন অনেকেই আইজউদ্দিনের কষ্ট দূর করতে এগিয়ে আসেন। ব্যক্তি আইজউদ্দিনের কষ্ট সেই সময়ে কিছুটা লাঘব হলেও, এই সময়ে দেশের সব শ্রেণীর মানুষ তার চেয়েও ভয়াবহ কষ্টে পড়েছে। জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের কাছে জিম্মি হয়ে তাদের জীবন যাচ্ছে, শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে পড়ে হাঁসফাস করছে। আইজউদ্দিনের কষ্ট প্রকাশের দেয়াল লিখন এখন ‘গ্রাফিতি’তে রূপ লাভ করেছে। গ্রাফিতির ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রাচীন মিসর, গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে এর নির্দশন পাওয়া যায়। এর মূল উপজীব্য হচ্ছে, সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ঘটনা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা। বাংলাদেশে দেয়ালে এই গ্রাফিতি নজরে পড়ে গত বছরের ২০ আগস্ট। ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থানে ‘সুবোধ’ নামে গ্রাফিতি সিরিজ অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা সুবোধ কখনো বাক্সবন্দী সূর্য হাতে পালাতে উদ্যত, কখনো জেলে বন্দী, কখনো হতাশায় নুয়ে পড়া একজন মানুষ। সুবোধকে লক্ষ্য করে গ্রাফিতিতে বলা হয়েছে, সুবোধ, তুই পালিয়ে যা, সময় এখন ভালো না। ঢাকায় নতুন এই দেয়ালচিত্র দেখে অনেকে চমকে উঠেছেন। অনেকে যা বোঝার বুঝেছেন। মূলত রাজনীতি ও সরকারের আচরণ এবং শাসন ব্যবস্থা যে সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে, তাই এসব শিল্পকর্মে সুবোধ চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, এই বার্তাটিই দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ সুবোধ সিরিজের আরেকটি গ্রাফিতি প্রকাশিত হয় গত ২১ এপ্রিল। এতে দেখা যায়, বিষাদগ্রস্ত এক কিশোরী ফ্রেমে বাঁধা বাংলাদেশের পতাকা পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ বিপদগ্রস্ত। এই বিপদে একে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরতে হবে। বর্তমানে দেশের শাসন ব্যবস্থা এবং রাজনীতির যে দুর্দশা তা বহুদিন ধরেই বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এজন্য মূলত ক্ষমতাসীন দলকেই দায়ী করতে হবে। কারণ তার শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা গোটা রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। তার একগুঁয়েমি, কর্তৃত্ববাদী মনোভাব, গণতন্ত্রকে পেছনে ঠেলে দেয়া, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, বিরোধী রাজনীতি নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়া, আইনের শাসন এবং সুশাসনের দুর্বলতা দেশকে এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই অবদমিত এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বিভিন্নভাবে। ক্ষমতাসীন দল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ‘গর্ভনমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’কে এমনভাবে পরিবর্তন করে বুঝিয়ে দিয়েছে তার কাছে গণতন্ত্র হচ্ছে, গর্ভনমেন্ট অব দ্য পার্টি, বাই দ্য পার্টি পিপল, ফর দ্য পার্টি পিপল। ক্ষমতাসীন দল জনগণকে নয় নিজেকে সর্বেসর্বা ও সর্বশক্তিমান মনে করছে। তার এই শক্তির বিরুদ্ধে কেউ যাতে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে না পারে, এ জন্য বিরোধী দলকে দমন করে নিঃশেষ করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে চলেছে। অথচ ২০০৮ সালে দিন বদলের অঙ্গীকার নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তখন তাদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা। অতীতমুখী ও দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সুস্থ্য রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। তার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো আলামত বিগত দশ বছরের শাসনামলের মধ্যে পাওয়া যায়নি। ক্ষমতাসীন দলের আচরণে এটাই প্রকাশিত হচ্ছে যে, বিরোধী দল বলে কিছু থাকুক, তা তারা কোনোভাবেই চায় না। সর্বশেষ গত ১৯ মে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলেও আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে। এর অর্থই হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল আরেকটি ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে চায় এবং যেখানে বিরোধী দল বলে কিছু থাকবে না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মোহে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে, সে বিরোধী দলের অস্তিত্ব সহ্য করতে পারছে না। তার কথাবার্তা, আচার-আচরণে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে তাকে ক্ষমতায় থাকতে হবে। এজন্য কোনো কিছুর তোয়াক্কা করার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাসীন দলের এই প্রবণতা থেকেই মাঝে মাঝে গ্রাফিতির মাধ্যমে ‘সুবোধ’ সাধারণ মানুষের সামনে হাজির হয়। সচেতন ও সতর্ক করে।
তিন.
আমাদের দেশে যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, তার মধ্যে সেবকের চেয়ে শাসকের মনোবৃত্তি বেশি দেখা যায়। আগে একটু রাগঢাক থাকলেও এখন তার কোনো বালাই নেই। ক্ষমতাসীন দল বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার শাসন ভাল না লাগলে দেশ ছেড়ে চলে যাও, নয়তো চুপ করে থাক। আবার ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা তো মুখ ফসকে মনের কথা বলেই ফেলছেন, আওয়ামী লীগ আজীবন ক্ষমতায় থাকবে। এ ধরনের কথাবার্তা যে গণতান্ত্রিক নয় এবং যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার চিন্তার চূড়ান্ত প্রকাশ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গনতন্ত্রে যারা বিশ্বাস করে না এবং গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদী হয়ে দেশ পরিচালনা করে, তারাই এ ধরনের কথা বলে। তবে তাদের এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা যদি জনহিতৈষী হতো, তাহলে বোধ করি কারো আপত্তি থাকত না। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার দাপটেই ক্ষমতায় থাকতে চাইছে। জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করছে না। অথচ মহাথির মোহাম্মদ ২২ বছর শাসন করে যে মালয়েশিয়াকে আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে দেশ পরিচালনা করেছিলেন। তবে জনগণের কাছে ছিলেন প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে এবং একসময় স্বেচ্ছায় তিনি ক্ষমতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এখন আবার ৯২ বছর বয়সে তিনি সেই জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন এবং বলেছেন দুই বছর পর স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে মাহাথির মোহাম্মদ একজন কঠোর শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাকেই কেন আবার জনগণ নির্বাচিত করল? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ, মাহাথির মোহাম্মদ জনদরদী ছিলেন, জনকল্যাণে কাজ করেছেন। উন্নয়নের নামে জনগণকে ধোকা দেননি। জনগণও তা মনে রেখেছে এবং তারা মনে করেছে মালয়েশিয়ার দুঃসময়ে আবারও তাকেই প্রয়োজন এবং তিনিই পারবেন মালয়েশিয়াকে আরও উন্নত করে তুলতে। এ কারণেই তারা মাহাথিরকে ৯২ বছর বয়সেও নির্বাচিত করেছে। অর্থাৎ তিনি তার ক্ষমতাকে জনগণের সেবায় কাজে লাগিয়ে মন জয় করেছিলেন। আমাদের দেশে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। ক্ষমতাসীন দল প্রবল ক্ষমতাশালী, তবে এ ক্ষমতা জনকল্যাণে ব্যবহৃত না হয়ে জনগণের ওপর ছড়ি ঘোরানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের কল্যাণে ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল জনসেবক না হয়ে জনশাসকে পরিণত হয় এবং হয়ে উঠেছে। অথচ বিশ্বে এমন অনেক প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান নেতা ছিলেন এবং আছেন যারা ক্ষমতায় গিয়ে জনসেবার মনোভাব থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তারা চাইলে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন এবং জনগণও তাদের সানন্দে ক্ষমতায় থাকতে দিত। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা শুধু তার নিজ দেশেই প্রভাবশালী ছিলেন না, সারাবিশ্বেই তার একটি ইতিবাচক প্রভাব ছিল। সারাজীবন নির্যাতন সয়ে ক্ষমতায় গিয়েও তার স্বাদ নেননি বা আরাম করেননি। তিনি যখন ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রæয়ারী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে হাজারো জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘প্রিয় জনসাধারণ, আমি আপনাদের সামনে কোন মহামানব হয়ে হাজির হইনি। আমি হাজির হয়েছি আপনাদের একজন বিনয়ী ক্রীতদাস হিসেবে। আপনাদের অবিশ্রান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ-তিতীক্ষা আমাকে আপনাদের সামনে হাজির হতে সম্ভব করেছে। তাই, আমি আমার বাকি জীবন আপনাদের সেবায় উৎসর্গ করলাম।’ রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে ম্যান্ডেলা তার এ প্রতিশ্রæতির একটুও হেরফের করেননি। জনগণের সেবক হয়ে দেশ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর দেশের সেবা করে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে চলে গিয়েছিলেন। ক্ষমতায় না থেকেও বাকী জীবন মানুষের সেবা করে গেছেন। আমাদের দেশেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের সেবায় আকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই।’ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ ও জাতি অনেক বড়’-এই মূলমন্ত্র ধারণ করে দেশ পরিচালনা করেছিলেন। এসবই আমাদের কাছে ইতিহাস এবং সত্যিকারের ইতিহাস। জার্মান দার্শনিক হ্যান্স জর্জ গ্যাদামার-এর একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘সত্যিকারের ইতিহাস আমাদের অধীন নয়, বরং আমরাই তার অধীন।’ দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল আমাদের সত্যিকারের ও গৌরবময় ইতিহাসের অধীন হয়েও তার থেকে শিক্ষা নেয়নি বা নিচ্ছে না।
চার.
বর্তমান অবস্থায় আমাদের প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতারা যদি রাজনীতি থেকে অবসর নেন, তখন অবসর জীবনে যখন তাদের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসের দিকে তাকাবেন, তারা কি দেখবেন? যে রাজনীতি শুধুই জনসেবার, সেই রাজনীতিকে তারা কীভাবে ব্যবহার করেছেন? জনগণ কি তাদের দশকের পর দশক মনে রাখবে? আফসোসের বিষয় হচ্ছে, তারা দেখবেন সারা জীবন তারা শুধু দল ও দলীয় সমর্থকদের নেতা হয়েছিলেন, সত্যিকারের জনসেবক বা রাষ্ট্রনায়ক হতে পারেননি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেও ব্যক্তি এবং দলের উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। অবিসংবাদিত হতে পারেননি। সচেতন মানুষ মাত্রই বিষয়গুলো নিয়ে এখন চিন্তা করছেন। এখন রাজনীতির এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, এতে কেবল প্রতিহিংসারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। বিশেষ করে শাসক দল যেন কিছুতেই তার প্রধান প্রতিপক্ষকে সহ্য করতে পারছে না। তাদের চাওয়া একটাই ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতা ভোগ করা। এখানে জনরায় ও জনমতের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যদি করা হতো, তবে এ কথা কি বলতে পারে, কে নির্বাচনে এলো বা না এলো তাতে কিছু যায় আসে না। এ ধরনের মনোভাব তো কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নয়। গণতান্ত্রিক হলে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলত। আমাদের দেশের বহু দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনের যে সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীন দল তা বিলুপ্ত করে দিতে চাচ্ছে। যেমনটি করা হয়েছিল সব দল বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে। আধুনিক যুগে এসে এ মতবাদ কিছুটা পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে ক্ষমতার অংশীদারিত্বের সুযোগ দিয়ে সংসদে নামকাওয়াস্তে একটি বিরোধী দল রাখা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এটাই চাচ্ছে। যাদেরকে তার অধীনে অকার্যকর বিরোধী দল এবং নিজের একচ্ছত্র শাসনের ছাতার নিচে আনার নীতিতে বশ মানাতে পারছে না, তাদেরকে যে কোনো উপায়ে ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে ইতিহাস সাক্ষী, গণতন্ত্রকামী যে দেশেই ক্ষমতাসীনরা এ ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাদের পরিণতি সুখকর হয়নি। আর বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের যে কোনো দেশের মানুষের চেয়ে বেশি গণতন্ত্রকামী। তাদের হয়তো কিছু সময়ের জন্য দমিয়ে রাখা যায়, তবে দীর্ঘ সময় বা চিরকালের জন্য তা করা যায় না। দেয়াল লিখন বা গ্রাফিতির মাধ্যমে যে বক্তব্য ফুটে উঠেছে, তা বাংলাদেশের মানুষের অবদমিত মনের কথারই বহিঃপ্রকাশ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn