সুষ্ঠু ভোটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নানা হিসাব
সিলেট সিটি করপোরেশন
সিলেটে দুই মেয়াদে মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগের বদরুদ্দিন আহমেদ কামরান। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে তিনি বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হারেন। তবে সিলেটের এবারে মেয়র নির্বাচন খুব সহজ অঙ্ক করার মতো অবস্থায় নেই। এর কারণ, এবার এ সিটিতে বিএনপির জোটে বিবাদ প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২০-দলীয় জোটের অন্যতম দল জামায়াত এ সিটিতে প্রার্থী দিয়েছে। তাঁকে সরিয়ে আনার কোনো চেষ্টা সফল হয়নি। গত শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জামায়াত প্রার্থী বাস্তবতা বুঝে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন, এটা তাঁর বিশ্বাস। তবে জামায়াতের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা নির্বাচন থেকে সরছেন না। এর কারণ প্রসঙ্গে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপিকে সমস্ত নির্বাচনে ছাড় দিচ্ছে জামায়াত। কিন্তু কোথাও আমরা নেই। এটা আমাদের অস্তিত্বের জন্যই তো হুমকিস্বরূপ।’ জামায়াতের ঘাড়ের কাছে গরম নিশ্বাস ফেলছে আরেকটি ইসলামি দল বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন। দলটি কয়েকটি সিটিতে ভালো সংখ্যায় ভোট পেয়েছে। সিলেটের স্থানীয় এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জামায়াতের বড় লড়াইটা হবে অন্তত ইসলামী আন্দোলনের চেয়ে বেশি ভোট পাওয়া। আর তা যদি তারা না পায়, তবে জোটের ভেতরে দর-কষাকষির লড়াইয়ে অবস্থান আরও নাজুক হয়ে যাবে।’ জামায়াতের প্রার্থীকে ফেরানোর চেষ্টা যে মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে, তা পরিষ্কার হলো সিটিতে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কথাতেও। জামায়াতকে নিয়ে আরিফুল হকের উত্তরে এবার তেমন উত্তাপ নেই। বললেন, ‘আমি বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।’ সিলেটের এই আসনে গত চার সংসদ নির্বাচনে ব্যবধান খুব বেশি হয়নি। সংসদ নির্বাচনের সেই ফলের মতো এবারের নির্বাচনেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে—এমনটাই মনে করেন আরিফুল হক। তিনি বলেন, ‘২ থেকে ৩ শতাংশ ভোটের ব্যবধান হবে। হ্যাঁ, লড়াই ভালো হবে। তবে সুষ্ঠু ভোট হলে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত।’
শাসক দল আওয়ামী লীগও ‘বিপুল বিজয়’ আশা করে সিলেটে। আর তাদের এই চাওয়ার পেছনে যুক্তি হলো, গত পাঁচ বছর বিএনপির প্রার্থী তেমন কিছু করতে পারেননি। নগরের মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে, সরকারি দলের প্রার্থী না থাকলে উন্নয়ন হয় না। আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরুদ্দিন আহমেদ কামরানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব আসাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রার্থীর অতীত অবস্থান আর দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের উন্নয়নকাজের ফসল আমরা পাব। মানুষ উন্নয়নের পক্ষে ভোট দেবে। সিলেটে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান আছে। এর ফল আমরা পাব।’ প্রতীকের নির্বাচন হলেও এবার সিলেট সিটির নির্বাচনে ব্যক্তির ইমেজ বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেট জেলা কমিটির সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রতীক বিবেচনা না করে ভোট দেওয়ার মতো অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোটার আছেন বলে মনে হয়। এঁদের কাছে ব্যক্তিই বড়। এই ভোটাররা এখানকার নির্বাচনে একটি নিয়ামক শক্তি।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন
রাজশাহী সিটি করপোরেশন জাতীয় সংসদের রাজশাহী-২ আসনের পুরোটাই সিটি করপোরেশনের মধ্যে পড়েছে। এ আসনে একসময় নির্বাচন করতেন চার জাতীয় নেতার একজন এ এইচ এম কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালের পর এ আসনে আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন বিজয়ী হতে পারেনি। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের তিন নির্বাচনেও হেরেছে। ১৯৯১ সালে এখানে জামায়াত দ্বিতীয় স্থান পায়। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে নৌকা মার্কা প্রতীক নিয়ে মহাজোটের প্রার্থী ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফজলে হোসেন বাদশা জয়ী হন। ২০০৮ সালে সিটির মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা কামারুজ্জামানের ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র নির্বাচিত হন। পরে ২০১৩ সালে অবশ্য ৪৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে যান বিএনপির বর্তমান মেয়রের কাছে। তবে বিএনপির মেয়র বুলবুল গত পাঁচ বছর তাঁর মেয়াদের প্রায় অর্ধেক সময় বিভিন্ন মামলায় কারাগারে ছিলেন।
রাজশাহী সিটির নির্বাচনে অতীতের ফলাফল বিবেচনা করে বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল আশাবাদী, যদি তাঁর এজেন্টদের ঠিকমতো ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয় এবং ভোটারদের আসার মতো পরিবেশ থাকে, তবে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন। বুলবুল বলেন, ‘বলা হচ্ছে, আমার সময় কোনো উন্নতি হয়নি। আমি তো অর্ধেক সময় কারাগারে ছিলাম। নগর চালিয়েছেন খায়রুজ্জামান এবং তাঁর আত্মীয় ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিজামুল আজিম। উন্নয়ন যদি না হয়ে থাকে, তবে এর দায় তো তাঁদের।’ বুলবুলের কথায় স্পষ্ট, এবারের নির্বাচনে ‘উন্নয়ন’ ইস্যুটিকে তাঁর বেশ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহীর মেয়র থাকার সময় নগরটির রাস্তাঘাট প্রশস্ত হয়েছিল, নগরের পথে পথে বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছিল, যানজট কমেছিল। তবে গত পাঁচ বছরে নগরের রাস্তাঘাটগুলোর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে, মশা বেড়েছে, যানজট সৃষ্টি হয়েছে অনেক জায়গায়। লিটনের সময়কার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। এটি এবারের নির্বাচনে একটি ইস্যু হবে বলে মনে করেন এই শিক্ষক। তবে বুলবুলের কথা, যে উন্নয়নের কথা লিটনের সময় হয়েছে বলে প্রচারিত হচ্ছে, তাতে অনেক ফাঁক আছে। তিনি বলেন, ‘লিটন সাহেব চায়নিজ রেস্তোরাঁর বাতি রাস্তায় লাগিয়েছিলেন। রাজশাহীর কোনো সড়কে এখন এলইডি বাতি ছাড়া নেই। সরকারের অসহযোগিতার পরও অনেক কাজ করেছি।’ বুলবুল মনে করেন, নগরবাসীকে গত পাঁচ বছরে যেভাবে বঞ্চনা করা হয়েছে, তাঁকে বিজয়ী করার মাধ্যমে তাঁরা এর জবাব দেবেন।
খায়রুজ্জামান লিটন মনে করেন, এবারের নির্বাচনে মানুষ তাঁকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করবেন। ভোটের প্রচারের তিনি এমন ইঙ্গিতই পাচ্ছেন। লিটন বলেন, ‘রাজশাহীবাসী বুঝেছে, গত নির্বাচনে তারা ভুল করেছে। এমন এক ব্যক্তিকে ভোট দিয়েছে, যিনি কোনো নাগরিক সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ খায়রুজ্জামান লিটন মনে করেন, অনেক উন্নয়নকাজ করার পরও নেতিবাচক প্রচারণায় গত মেয়র নির্বাচনে তিনি হেরেছেন। তবে দেশের সার্বিক উন্নয়নের একটি প্রভাব রাজশাহীর সিটিতে পড়বে। আর উন্নয়নমুখী মানুষ তাঁকেই জয়ী করবে।
স্থানীয় সরকার নিয়ে গবেষণা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মকসুদুর রহমান। ‘বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন’ নামে একটি বহুল পঠিত বইয়ের লেখক তিনি। অধ্যাপক মকসুদুর মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের ইস্যুর পাশাপাশি রাজশাহীতে স্থানীয় উন্নয়ন একটি বড় ইস্যু হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে। এটি এ নির্বাচনে একটি বিবেচ্য বিষয় হবে। ‘উন্নয়ন’ বরিশাল ও রাজশাহী সিটির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলেও সিলেটের বিষয়টি কিন্তু ভিন্ন। সিলেট সব সময় বিজয়ীর পক্ষে থাকে—সিলেট সদর আসন নিয়ে এমন একটি কথা চালু আছে। আর এটি অমূলকও নয়। এই সদর আসনজুড়েই সিটি করপোরেশন। আর বিগত চারটি সংসদ নির্বাচনে যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, সদরের এই আসনে জিতেছেন সেই দলের সংসদ সদস্য। এখন ক্ষমতায় থাকা দলের প্রতি সিলেটবাসী সমর্থন দেবে না। এখানে ‘শাসকের প্রতি স্বাভাবিক’ বিরূপ মনোভাব কাজ করবে?
বরিশাল সিটি করপোরেশন
বরিশাল সিটি করপোরেশনের পুরোটাই এবং সদর উপজেলার ১০ ইউনিয়ন মিলে বরিশাল-৫ সংসদীয় আসন। বরিশালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহর বাবা আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ স্বাধীনতার পর বরিশাল পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হন। ১৯৭৫ সালের পর বরিশালে আওয়ামীবিরোধী শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত একটি নির্বাচনেও এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হতে পারেননি। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বড় ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হারেন। ২০০৮ সালে ব্যবধান বেশ কমে আসে। সেবার আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের সময়ও এবারকার বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সারোয়ার ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। ২০০৮ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ নির্বাচনে বিজয়ী হন। তবে ২০১৩ সালের এ সরকারের মেয়াদে নির্বাচনে অন্য তিন সিটির সঙ্গে এ সিটিতেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারেন। নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী মো. আহসান হাবীব কামাল। এবার বরিশাল সিটিতে বিএনপি তার প্রার্থী পরিবর্তন করেছে। সাবেক সাংসদ মজিবর রহমান সারোয়ার এবার বিএনপির প্রার্থী।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কথা, গত পাঁচ বছরে সিটিতে বিএনপির মেয়র তেমন কাজ করতে পারেননি। এই প্রার্থী দিয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে সম্ভব না, বিএনপি তা বুঝতে পেরেই প্রার্থী পরিবর্তন করে। সিটির উন্নয়নবঞ্চিত মানুষ তবে কি এ দফায় শাসক দলের প্রতিই ঝুঁকবে? বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, গত পাঁচ বছরে নগরের মানুষ দেখেছে, কোনো উন্নয়ন হয়নি। একটি ঝকঝকে নগরকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। মানুষ উন্নয়ন চায়। আর এ জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে তাঁরা ভোট দেবেন। তবে বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সারোয়ার মনে করেন, বরং উল্টোটাই হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির মেয়রের পাঁচ বছর ধরে কাজ করতে না পারার পেছনে সরকারের বৈরী মনোভাব ছিল। নগরবাসী দেখেছে, তাদের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তা সরকারের সিদ্ধান্তেই করা হয়েছে। এর জবাব তারা দেবে। সারোয়ার মনে করেন, বরিশালকে সিটি করপোরেশন করা, একে বিভাগ করা, বিশ্ববিদ্যালয় করা—এসবই হয়েছে বিএনপির আমলে। তাই উন্নয়ন যা হয়েছে, তা বিএনপিই করেছে। স্থানীয় উন্নয়ন ইস্যুর বাইরে দলীয় প্রতীক এখানে একটি নিয়ামক শক্তি হবে বলে বরিশালের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
সুজনের জেলা সভাপতি রফিকুল আলম মনে করেন, অতীতের নির্বাচনের ফলাফল একটি বিষয়। তবে এখন দলীয় ঐক্য একটি বড় ফ্যাক্টর। আর সেই বিবেচনায়, কোন দল ভালো ফল করবে, তা বলা মুশকিল। ১৯৭৫ সালের পর বরিশালে আওয়ামী লীগের অবস্থা খারাপ থাকলেও সিটির প্রয়াত মেয়র আওয়ামী লীগে আসার পর দলটির অবস্থান ভালো হয় বলেও জানান রফিকুল আলম। দলটি এখন আগের চেয়ে সংহত বলেও মনে করেন তিনি। বরিশালে দেখা গেছে, আগের তিন সংসদ নির্বাচনের তুলনায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের ব্যবধান কমিয়ে নিয়ে আসে অনেক। তবে বিএনপি নেতা সারোয়ার বলেন, ‘২০০৮ সালে বলা যায় আসামির মতো নির্বাচন করেছি। পুরো প্রশাসন থেকে সব মহল আমাদের বিপক্ষে কাজ করেছে। ওই নির্বাচনের ফল তাই প্রশ্নবিদ্ধ।’ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য বলেন, এখানে নেতিবাচক রাজনীতিই করা হয়েছে। জনমনে এখন পরিবর্তন হয়েছে। ইতিবাচক ও উন্নয়নের রাজনীতি বিকশিত হচ্ছে। সিটি নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটবে।-সূত্র প্রথম আলো।