দৃষ্টি সবার ফেসবুকে গুরুত্ব হারাচ্ছে গণমাধ্যম
দেশের খবর কি? কেউ জানতে চাইলেই উত্তর আসে ‘ফেসবুক দেখেন’। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অবস্থা কোন পর্যায়ে? ‘উত্তর ফেসবুকে দেখলেই বোঝা যাবে’। ঢাকাসহ সারাদেশে যানবাহন কি চলছে? ‘ফেসবুক খুললেই খবর পাবেন’। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যান্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত মানুষের প্রায় একই জিজ্ঞাসা; অভিন্ন উত্তর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি গণমানুষের এই নির্ভরশীল হয়ে ওঠার রহস্য কী? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমকে বলা হয় ‘চতুর্থ স্তম্ভ’। সেই গণমাধ্যম তথা পত্রিকা-টেলিভিশন পাঠক-দর্শকদের কাছে ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব হারাচ্ছে। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলো চরিত্র বদল করে ‘প্রচার মাধ্যমে’ রুপলাভ করায় কার্যত এমন পরিস্থিতি। গণমাধ্যমের উপর আস্থাহীনতায় আমজনতার কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ভরশীলতার প্রতীক। গণমাধ্যম সমাজ জীবনের দর্পন স্বরূপ। প্রশ্ন হচ্ছে মিডিয়াগুলো কী সে দায়িত্ব পালন করছে? স্কুল পড়–য়া ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নেমে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বড়দের অনেক কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে। বড়রা সেটা স্বীকারও করছেন। কিশোর-কিশোরী ছাত্রছাত্রীদের সেই পরিচ্ছন্ন আন্দোলনের ব্যাপকতা কী গণমাধ্যমগুলো তুলে ধরছে? গণমাধ্যম এখন মানুষের জাপিত-জীবনের তথা সমাজের অংশ হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের প্রভাব প্রতিপত্তি সর্বজন স্বীকৃত। আমাদের চলমান জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কাজ, ছোট ছোট ঘটনাগুলো প্রতিফলিত হয় গণমাধ্যমে। জীবন ও সমাজের সাথে গণমাধ্যম ওতোপ্রোতভাবে মিশে গেছে। গণমাধ্যমের দ্বারা প্রভাবিত হয় মানুষ। সমাজের ওপর গণমাধ্যমের প্রভাব এত বেশি যে গণমাধ্যম চাইলেই মানুষের কোনো বিষয় ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে পারে; আবার নেতিবাচকভাবেও দেখতে পারে। গণমাধ্যম মানুষের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে পারে; আবার ভুল ও বিকৃত তথ্য দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা-নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। খুব সামান্য একটি বিষয়কেও গণমাধ্যম তার উপস্থাপনের মাধ্যমে বড় করে তুলতে পারে। আবার ছোট ঘটনাকে বড় করে তুলতে পারে। গণমাধ্যম একদিকে যেমন সমাজের চলমান চিত্র তুলে ধরে; তেমনি অন্যদিকে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ভাঙ্গা-গড়ায় প্রভাবিত করে থাকে। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমগুলোর কী ভূমিকা রাখছে? ক্ষমতাসীনদের অঘোষিত চাপে মিডিয়ায় এক ধরণের ‘সেল্ফ সেন্সরসিফ’ বিদ্যামান; কিন্তু গণমাধ্যমকে যদি শুধুই প্রচার মাধ্যম হয় তাহলে জনগণ খবর জানতে বিকল্প পথ তো খুঁজবেই ?
বিগত দুই দশকে দেশে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিপ্লব ঘটেছে। দর্শকরা প্রথম দিকে মিডিয়াগুলোকে গ্রহণও করে। কিন্তু টিভিগুলো ক্রমান্বয়ে চরিত্র বদল করে প্রচার মাধ্যমে রুপলাভ করে। আমজনতার প্রত্যাশা ও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার বদলে ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের স্বার্থ দেখা এবং খেয়ালখুশি মতো প্রচারণায় নামায় টিভি খবরের প্রতি দর্শক আগ্রহ হারায়। পক্ষান্তরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, বøগ, টুইটার, ইউটিউব সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন বিষয় ও ইস্যু নিয়ে নানাবয়সী পাঠক-দর্শকদের যেভাবে ফেসবুকের প্রতি ঝুকে পড়তে দেখা যাচ্ছে; সে ভাবে গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হতে দেখা যাচ্ছে না। লাখ লাখ দর্শকের কাছে ফেসবুক যাপিত জীবনের অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে।
তথ্য-উপাত্ত ও খরবের জন্য এক সময় গণমাধ্যমের উপর ছিল মানুষ নির্ভরশীল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় দেখা গেছে দেশের মানুষ ঘটনার প্রকৃত তথ্য জানতে সন্ধ্যার বিবিসি’র খবর শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। ২০ বছর আগেও দেখা গেছে দেশের মানুষ একমাত্র টেরিস্ট্রোরিয়াল চ্যানেল একুশে টিভির সচিত্র খবরের জন্য মুখিয়ে থাকতো। ১৫ বছরে দেশে টিভি মিডিয়ার বিপ্লব ঘটেছে। কোথাও কিছু ঘটলেই ৪০ থেকে ৫০টি টিভি ক্যামেরা হাজির। অথচ এখন টিভির খবর দেখার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ তেমন দেখা যায় না। এক সময় টিভির টকশো শোনার জন্য দর্শকরা মুখিয়ে থাকতেন; রাত জাগতো। এখন সেই টকশো’র প্রতিও দর্শকদের আগ্রহ কম। কারণ কী? কারণ হলো জনগণ যা জানতে চায় তা জানাতে মিডিয়াগুলোর ব্যর্থতা। গত বছর গাইবান্ধায় সাঁওতালদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। দেশের মিডিয়াগুলো সে খবর প্রচারও করে। কিন্তু দুই সাপ্তাহ পর কাতার থেকে প্রচারিত আল জাজিরা টিভিতে গাইবান্ধায় সাঁওতালদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার সচিত্র খবর প্রচারের পর দেশের পাঠক-দর্শক প্রকৃত চিত্র জানতে পারে। এতেই বোঝা যায় দেশের টিভিগুলো খবরের গভীরতার দৌঁড়!
প্রায় এক সাপ্তাহ থেকে দেশে স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ সড়কসহ ৯ দফা দাবিতে রাস্তায় আন্দোলন করছে। তাদের এই আন্দোলনে প্রশাসন যন্ত্র ও সমাজের অনেক অসংগতির চিত্র উঠে এসেছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা প্লাকার্ড, ব্যানানে যে সব ভাষা ব্যবহার করছে; তাতে বড়দের শেখার আছে অনেক কিছু। প্রশ্ন হচ্ছে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের এসব আন্দোলন, দাবির ব্যাপকতা, জনসমর্থন কী টিভি মিডিয়াগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে? কয়েক বছর আগে শাহবাগের একটি স্পটের মাসব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি যেভাবে মিডিয়াগুলো ফলাও করে প্রচার করে; মতিঝিলের হেফাজতের সমাবেশ যেভাবে প্রচার করে; তার দশ ভাগের এক ভাগ গুরুত্ব দিয়ে কী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দেশব্যাপী আন্দোলনের ব্যাপকতার খবর প্রচার করেছে? শাহবাগ বা মতিঝিলের কর্মসুচি এক স্পটে সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন হচ্ছে রাজধানী ঢাকায় কমপক্ষ্যে একশ স্পটে। ঢাকার বাইরেও বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা থেকে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে এবং রাজধানী হয়ে পড়েছে অচল। মানুষ ভোগান্তি মেনে নিয়েই আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই প্রাইভেট কার ও বাসের লাইসেন্স পরীক্ষা করছে। মন্ত্রী, এমপি, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ উপরতলার মানুষের গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারদের লাইসেন্স, গাড়ীর ফিটনেস পরীক্ষা করেছে। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এ্যাম্বুলেন্স যাতায়াতে সহায়তা করেছে, পথচারীদের সুবিধার জন্য রাস্তা ঝাড়– দিচ্ছে, শিশুদের রাস্তা পাড় করে দিচ্ছে; এমনকি নানা ভাষায় স্লোগান দিয়ে আইনের শাসন কায়েমের দাবি জানিয়েছে। অথচ এসব খবর মিডিয়ায় বিশেষ করে টিভিগুলোতে তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে না। নামকাওয়াস্তে এই খবরগুলো প্রচার করা হচ্ছে। খবর জানতে বাধ্য হয়েই মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রতি ঝুকে পড়ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে দেশে কি ঘটছে, কোথায় কি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও দাবি নিয়ে কে কি বলছেন, এসব নিয়ে মন্ত্রী এপিদের কথাবার্তা, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্য সবকিছু জানার জন্য মানুষ ফেসবুকের দিকে ঝুকে পড়েছে। অথচ এ সব খবর জানতে এক সময় মানুষ-দর্শক টিভির ‘সচিত্র খবর’ দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতো। এখন প্রিন্ট মিডিয়ার খবর দেখলেও টিভি খবর দেখার জন্য অপেক্ষা করে না দর্শক। কোনো কিছু ঘটলেই সে সম্পর্কে জানার জন্য দ্রুত ফেসবুক খুলে বসে মানুষ। এমনকি যারা মিডিয়ায় কাজ করেন সেই সাংবাদিক এবং সংবাদকর্মীরাও টিভি খবরের ওপর নির্ভরশীল হতে পারছেন না। তারা নিজেরা খবর লেখেন-প্রচার করেন; তারপরও সময় পেলেই বৃহৎ পরিসরে খবর জানতে ফেসবুক নিয়ে বসেন। প্রশ্ন হলো আমাদের গণমাধ্যমগুলো থেকে কী সততা, বস্তুনিষ্ঠতা, নৈতিকতা ও পেশাদারিত্ব উঠে যাচ্ছে? তা না হলে দর্শক খবর জানতে ফেসবুক মুখী হচ্ছে কেন? গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য এটা হতাশাজনক খবর নয় কী?