সিলেটে টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে সহস্রাধিক পরিবারের বাস
সিলেটে পাহাড়-টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে টিলা ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে জীবনঝুঁকিতে পড়তে পারে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের। জানা যায়, সিলেট নগরসহ জেলার ৮টি উপজেলায় টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে প্রায় ২০ হাজার লোক বসবাস করছেন। বিগত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের এই টিলাগুলো ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে গোলাপগঞ্জে টিলা ধসে পরে। এতে টিলার পাদদেশের ঘরগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ঘরের বাসিন্দারা দ্রুত বেরিয়ে পড়লে প্রাণে রক্ষা পান। তবে তাদের গৃহপালিত ৩ টি গরু মাটি চাপা গুরুতর আহত হয়। এরআগে গত বৃহস্পতিবার সিলেটে শহরতলীর গোয়াবাড়ি এলাকার জাহাঙ্গীরনগরে একটি টিলা ধসে পড়ে। এসময় টিলার পাদদেশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিলেও কোন হতাহতের ঘটনা ঘেটেনি। এদিকে, প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে সিলেটের টিলা ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে টিলা পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন বা নিরাপদে সরিয়ে নিতে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই।
গত কয়েকবছরে সিলেটের গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ফেঞ্চুগঞ্জ, নগরের শাহী ঈদগাহসহ কয়েকটি এলাকায় টিলা ধসে অন্তত ২০ জন মারা গেছেন। অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে এমন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেটে পাহাড়-টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে কতটি পরিবার বসবাস করছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তবে সেভ দ্যা হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ২০১৭ সালের জরিপে দেখা গেছে, সিলেটে টিলার পাদদেশে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে প্রায় ১০ হাজার লোক। তবে এ সংখ্যা বর্তমানে দিগুণ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সংশ্লিস্টরা। এ ব্যাপারে সেভ দ্যা হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ টিলার ওপর সেভ দ্যা হেরিটেজের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। এতে দেখা গেছে সিলেট শহরতলি ও বিভিন্ন উপজেলায় টিলা কেটে এর পাদদেশে অন্তত ১০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। তবে বর্তমানে এ সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। খবর পেয়েছি এবছর শুধুমাত্র সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নেই টিলার পাদদেশে বসবাসকারী বেড়েছে ৫ হাজার। এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই এই বর্ষা মৌসুমে টিলাগুলো ধসে পড়ে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
সিলেট নগর, নগরের উপকণ্ঠ ও সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় টিলা ও পাহাড় কেটে কাঁচা-আধাপাকা বাড়ি নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে সহ¯্রাধিক পরিবার। একশ্রেণীর ভূমিখেকোরা টিলা কেটে ভূমি দখলে রাখতেও টিলার পাদদেশে ঘর নির্মাণ করে ভূমিহীন দরিদ্রদের ভাড়া দিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। সরেজমিনে নগরের জাহাঙ্গীরনগর, গোয়াবাড়ি ও হাওলাদার পাড়া ঘুরে দেখা গেছে, টিলার পাদদেশে ও টিলার উপরে কয়েকশ’ পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে টিলার বিভিন্ন অংশে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে ৭ মাস যাবত বসবাস করছেন গৃহিনী হনুফা বেগম। স্বামী রুপন আহমেদসহ ৩ সন্তান নিয়ে টিলার একাংশ ঘর বানিয়ে থাকছেন। হনুফা বেগম বলেন, স্বামী এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। টিলার নিচে বৃষ্টির সময় থাকা অনেক ঝুঁকির এটা জানি। তারপরও আমাদের কিছু করার নেই এখানেই থাকতে হবে। বৃষ্টি হলে আতঙ্কে থাকি।
জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় আলীবাহার চা বাগানের টিলার নিচে বসবাস করে ১০ পরিবার। এই পরিবারগুলোতে ১২জন শিশুসহ প্রায় ৪০জন থাকেন। এখানে বসবাসরত সবাই দরিদ্র ও ভূমিহীন। বেশিরভাগ মানুষই দিনমুজুর। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আলীবাহার বাগান কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে তারা ঘর বানিয়ে এখানে বসবাস করছেন। এখানকার বাসিন্দা বেবি বেগম। তার স্বামী রংমিস্ত্রি। স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে টিলার নিচে একটি টিনের ঘরে বসবাস করেন তিনি। বেবি বেগম বলেন, টিভিতে দেখি বৃষ্টি হলে টিলা ধসে মানুষ মারা যায়। এখন এই জায়গা ছাড়া আমাদের থাকার কোনো স্থান নেই। তাই ঝুঁকি জেনেও এখানে থাকছি। একই এলাকার আরেকজন বসবাসকারী লিজা বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ কোথায় যাবো। জানি বেশি বৃষ্টি হলে টিলা ধস হয় কিন্তু আমাদেরতো আর যাওয়ার জায়গা নেই। তাই ঝুঁকি নিয়ে এখানেই থাকতে হবে।
টিলার পাদদেশে বসবাসকৃত মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ বলে নি বলে জানান হনুফা, বেবি ও লিজা। তারা বলেন, আমরাতো সারাদিন ঘরে থাকি এখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য কেউ বলেনি। এছাড়া নগরের উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েক শত পরিবার। জৈন্তাপুর উপজেলার নয়াখেল, আঞ্জাগ্রাম ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বিভিন্ন টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন আরো অনেক পরিবার।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র টিলার পাদদেশে বাড়ি নির্মাণ করে ভূমিহীনদের কাছে ভাড়ার দিয়ে থাকে। অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ভাড়া পাওয়ায় মৃত্যুঝুঁকি সত্ত্বেও এসব বাড়ি ভাড়া নেন অসহায় লোকজন। স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালী ভূমিখেকোরা অবৈধভাবে টিলা কাটার ফলে বর্ষা মৌসুমে ধসের আশঙ্কা আরো বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, প্রতি বছর বর্ষা এলেই পাহাড়ের পাদদেশে থাকা মানুষদের নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয় কিন্তু বছরজুড়ে কোন নজরদারী থাকে না। মূলত পাহাড়-টিলা কেটে সমতল করার চক্রান্তের অংশ হিসাবে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বস্তি তৈরির অসংখ্য নজির আছে সিলেট নগরের ভিতরই। মানুষের বসতি রেখে এক ঠেলা, দুই ঠেলা করে টিলা কেটে মাটি বিক্রি ওপেন সিক্রেট। এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, টিলার নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তারপরও বৃষ্টি হলে আমরা ওইসব এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য বলছি। এখন কারো ব্যক্তি মালিকানা টিলায় আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না। তারপরও সচেতনতা বাড়াতে আমরা কাজ করছি।