ফেসবুক যুগে ‘বন্ধুত্ব’
‘বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে/ভেঙে যায় গ্রাম, নদীও শুকনো ধুধু।’ বন্ধুত্ব নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন ‘সাঁকোটা দুলছে’ নামের কবিতাটি। বন্ধু হারালে এখনও কি কেউ এই পঙ্ক্তিগুলো আওড়াতে আওড়াতে মন খারাপ করা বিকেল কাটান? নাকি যখন-তখন ফেসবুক বন্ধুকে ব্লক করতে করতে একন বন্ধুত্বের মানেই বদলে গেলো? এখন কি আর হারিয়ে ফেলা বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধারে প্রাণ আনচান করে কারও? সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অভিমত, বন্ধুত্বের ধরন বদলে গেছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে তারা বলছেন, ফেসবুক যুগে এসে বন্ধুত্ব এখন ‘দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু/ পরকে করিলে ভাই’ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনেক দিনের পুরনো বন্ধুত্ব অচেনা হয়ে যাচ্ছে, অথচ নতুন কেউ এসে হয়ে উঠছে ঘনিষ্ঠ-নির্ভরযোগ্য বন্ধু। শিক্ষক-সাংবাদিকরা বলছেন, ফেসবুকের যুগে যখন এক ক্লিকেই বন্ধুর দেখা মেলে, তখন কে প্রকৃত বন্ধু, আর কে মেকি, তা যাছাই করা কঠিন। তবে তাদের মতে, ফেসবুক ও ফেসবুক-ফ্রেন্ডসের বিষয়টি যথাযথভাবে জানাটা জরুরি। সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক কাকলী তানভীর মনে করেন, ‘‘ফেসবুক যুগে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দের ভুল ব্যবহার হচ্ছে।’’ বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টিকে আমি যথেচ্ছাচারও বলি! কারণ যে কোনও মানুষই বন্ধু হওয়ার যোগ্য নন, এমনকি বন্ধু বলে ডাকাটাও ভীষণ অর্বাচীন বলে মনে করি! বড়জোর ‘পরিচিত’ বলা যেতে পারে। এ কারণে ‘বন্ধু’ শব্দের গভীরতা ও মূল্য বোঝতে অনেকেই ব্যর্থ হচ্ছেন, যার ফলে অকারণ অস্বস্তির মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই!’’ এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘ফেসবুকে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেই অনেক সময়ই একে অন্যের ব্যক্তিজীবনে অযাচিত উঁকি দেওয়াসহ মন্তব্যের উদ্দেশ্য মুখ্য হয়ে ওঠে! যা একেবারেই কাম্য নয়। কারণ রাস্তার কোনও মানুষকে যদি আমার জীবনযাপন জানাতে ইচ্ছুক না হয়ে থাকি, তাহলে ফেসবুক বন্ধুকে কী করে সেই দ্বার খুলে দিচ্ছি? এটি স্ববিরোধী নয়?’
ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড তো ভার্চুয়ালই, রিয়েল ফ্রেন্ডরাও ভার্চুয়াল হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন লেখক ও চাকরিজীবী ফখরুল আবেদীন মিলন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু/তাই রোজ বিকেলে একলা লাগে।’ এই লাইন আমারই কবিতার। আর আমার মতো যাদের ফেসবুকে বন্ধু বেশি, ফলোয়ার বেশি, তাদের অবস্থা বেশি খারাপ। যেমন আমার ওপর আমার রিয়েল লাইফ বন্ধুদের অভিমান আর অভিযোগের শেষ নেই। তবে এটাও ঠিক যে, ফেসবুক আমাকে অনেক ভালো বন্ধুও দিয়েছে। আমি তাদের বন্ধুত্বের আন্তরিকতা টের পাই।বিদেশে ঘুরতে গেলে কাজ বাদ দিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে যারা আসেন, তাদের অনেকেই আমার ফেসবুক বন্ধু।’ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক নেহাল করীম বলেন, ‘সিস্টেম ঠিক না থাকলে কোনো কিছুই ঠিকমতো কাজ করবে না।’ তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এক ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। কোথাও নিশ্চয়তা নেই। এমন অবস্থায় মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে পরস্পরের থেকে।’ সমাজে একধরনের গোঁজামিল তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে নেহাল করীম আরও বলেন, ‘এই করপোরেট দুনিয়ায় সবাই কেবল নিজেরটা চায়, নিজেরটা বোঝে।’ বন্ধুর জন্য সময় ব্যয় করবে ঠিকই কিন্তু সেখানেও ‘ফায়দা’ খুঁজবে বলেও তিনি মনে করেন।