ঝুঁকি নিলেন বরিস জনসন
জাহিদুর রহমান – ব্রেক্সিট ঝড় বৃটিশ রাজনীতিতে অভিনব কোনো ঘটনা নয়। দুই প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় নিতে হয়েছে এই ঝড়ে। এবার দৃশ্যপটে নয়া প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। প্যারিসের জি-৭ সম্মেলন থেকে সবে ফিরেছেন। আর ফিরেই নাটকীয় এক সিদ্ধান্ত নিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ আর চ্যালেঞ্জিংও বটে। অক্টোবরে ব্রেক্সিট কার্যকরের আগে তিনি সংসদের কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বুধবার সকালে রাণীর কাছে পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত রাখার আর্জি জানান।রাণী এ সিদ্ধান্তে একমত হলে ব্রেক্সিটের আগে এমপিদের কোন বিল পাশ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। আকস্মিক এই সিদ্ধান্তে ঝড় ওঠেছে বিলাতের রাজনীতিতে। তার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিরোধীরা। বলছেন, এটি অগণতান্ত্রিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর বলেছেন, এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি আদালতে যাবেন। স্পিকার জন বারকোও প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। টরি ব্যাকবেঞ্চার ডমিনিক গ্রিয়েভ পরিকল্পনাটিকে সাংঘাতিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, এতে প্রধানমন্ত্রী জনসনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যেই এক লাখ মানুষ একটি পিটিশনে সিদ্ধান্ত স্থগিত করার পক্ষে সই করেছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বরিস জনসনের সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছে। বলেছে, এই সিদ্ধান্ত এক অশুভ ইঙ্গিত। সমপ্রতি শেষ হওয়া জি-সেভেন সম্মেলন শেষে বরিস জনসন বলেছিলেন, ইইউ থেকে বৃটেনের বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিট নিয়ে নতুন একটি চুক্তির প্রত্যাশা করছেন তিনি। ধারণা করা হয়েছিল, চুক্তি নিয়ে ইইউ ছাড়তে জোর দিচ্ছেন তিনি। তবে বুধবার এ নিজের অবস্থান পুরোপুরি পাল্টে দেন তিনি।
বৃটেনের স্থানীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, নতুন সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর কয়েকদিনের জন্য পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার রীতি রয়েছে বৃটেনে। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রানী এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। স্থগিতাবস্থা শেষে রানীর ভাষণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন অধিবেশন। পার্লামেন্ট বন্ধ থাকা অবস্থায় কোনো বিতর্ক, পক্ষে-বিপক্ষে ভোট চলতে পারে না। যেসব আইন পার্লামেন্ট থেকে পাস হয়ে আসতে পারেনি, পার্লামেন্ট বন্ধ থাকা অবস্থায় সেগুলো স্ব স্ব জায়গায় স্থবির থাকে। পূর্বের দৃষ্টান্ত অনুসারে, এই স্থগিতাবস্থা চারদিন থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু জনসন সরকার পাঁচ সপ্তাহের জন্য মুলতবি রাখতে চাইছে পার্লামেন্ট অধিবেশন। সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্ট সদস্যরা গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে কাজে ফেরার পরপরই পার্লামেন্ট স্থগিত ঘোষণা করতে চান তিনি। নতুন অধিবেশন শুরু হবে ১৪ই অক্টোবর। সেদিনই রানী ভাষণ দেবেন। পার্লামেন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করার এই রীতি- ‘প্ররোগেশন’ নামে পরিচিত। রানীর পক্ষে এই অবস্থায় সরকারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার সাংবিধানিক সক্ষমতা থাকলেও, বাস্তবে তা বেশ কঠিন হবে। বিবিসি’র প্রতিবেদক জনি ডাইমন্ড বলেন, রানী তার মন্ত্রীদের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আদতে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন না তিনি। সব সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিপরিষদই নিয়ে থাকেন। রানীর এখানে অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিরোধীদের অভিযোগ, চুক্তিহীন ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতেই সরকার এই পরিকল্পনা করছে। এতে করে নতুন অধিবেশনের পর ব্রেক্সিট কার্যকর হতে সময় থাকবে মাত্র দুই সপ্তাহ। উল্লেখ্য, বর্তমান চুক্তি অনুসারে আগামী ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এমতাবস্থায় সরকারের পার্লামেন্ট মুলতবির ঘোষণা বৃটেনজুড়ে রাজনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে। ব্রেক্সিট নিয়ে দেশটির রাজনীতিতে টানাপড়েন অবশ্য নতুন কিছু নয়। এখন পর্যন্ত ব্রেক্সিটের চক্করে তিন বছরে দুই প্রধানমন্ত্রী সহ এক ডজনের বেশি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদত্যাগ দেখেছে বৃটিশরা। দুইবার পাল্টেছে ব্রেক্সিট কার্যকরের সময়সীমা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের পরে ব্রেক্সিটের হাল ধরতে এসেছিলেন তেরেসা মে। নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন মে। মাঝপথেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। হারিয়েছেন কনজারভেটিভ দলের নেতৃত্ব। তার জায়গায় নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে প্রচারণার প্রথমদিকে বেশ কট্টর অবস্থান নিয়েছিলেন ব্রেক্সিট ইস্যুতে। চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেখিয়েছিলেন। পরে অবশ্য কিছুটা নরম হয়ে জানান, চুক্তি নিয়েই ইইউ ছাড়তে চান তিনি। যদিও বিরোধীদের দাবি, তিনি মূলত চুক্তিহীন ব্রেক্সিটই চাইছেন।
তবে জনসন দাবি করেন, চুক্তিহীন ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্য নিয়ে পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার আবেদন করা হয়নি। এমন অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। তিনি জানান, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান না তিনি। এ ছাড়া, ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনা করার জন্য পার্লামেন্ট খোলার পরও পর্যাপ্ত সময় পাবেন সংসদ সদস্যরা। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের নতুন আইন প্রয়োজন। আমাদের নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ বিল সামনে নিয়ে আসতে হবে। সেজন্যই আমরা রানীর ভাষণ শুনবো। তিনি আরো জানান, এই মুলতবি প্রয়োজনীয়। কারণ সরকারের কাছে একটি বিশেষ এজেন্ডা রয়েছে। তারা সেটি বাস্তবায়ন করতে চায়।
‘কর নয়তো মর’
বিবিসি’র রাজনৈতিক সমপাদক লরা কুসেনবার্গ জানান, সরকারের গুটিকয়েক মন্ত্রীরা এই পরিকল্পনা সমপর্কে আগ থেকে জানতেন। প্রধানমন্ত্রী জনসন জানান, তিনি ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে চুক্তি সহ ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যকে বের করে নিতে চান। তবে কোনো চুক্তি না হলেও তিনি ওই সময়ের মধ্যেই ব্রেক্সিট কার্যকর করতে চান। তিনি ব্রেক্সিট নিয়ে ‘কর নয়তো মর’ নীতি অনুসরণ করছেন। তার এই অবস্থান বিরোধীদের পক্ষ থেকে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। তারা চুক্তিহীন ব্রেক্সিট ঠেকাতে একজোট হয়ে পরিকল্পনা করছে। মঙ্গলবার বিরোধীদের জোট এক ঘোষণায় জানিয়েছে, তারা পার্লামেন্ট ব্যবহার করেই সরকারের চুক্তিহীন ব্রেক্সিট পরিকল্পনা রুখতে চায়। তবে এ বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা কী তা জানা যায়নি। এরপরই পার্লামেন্ট স্থগিত করার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে সরকার।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন আগামী সপ্তাহে পার্লামেন্টে একটি জরুরি বিতর্কের আহ্বান জানাবেন। এতে সংসদ সদস্যরা চুক্তিহীন ব্রেক্সিট ঠেকাতে নতুন বিল প্রস্তাবের সুযোগ পাবে। কিন্তু রানী যদি সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১০ই সেপ্টেম্বর পার্লামেন্ট বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিরোধীরা বিল পাসের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে না। এদিকে মন্ত্রীরা বলছেন, এমন সময়ে পার্লামেন্ট বন্ধ হলে তারা ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক ভূমিকা রাখতে পারবেন না। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজরসহ একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সরকারের এই ঘোষণার বিরোধিতা করেছেন। বিরোধী দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির মুখপাত্র জোয়ানা চেরি জানিয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে স্কটল্যান্ডের আদালতে পদক্ষেপটির বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন।
স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টার্জন পার্লামেন্ট স্থগিতের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, পার্লামেন্টের সদস্যদের আগামী সপ্তাহে এই পরিকল্পনা রুখতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, অথবা আজকের দিন ইতিহাসের পাতায় বৃটিশ গণতন্ত্রের জন্য কালো দিন হিসেবে বিবেচিত হবে। বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, সরকারের এই পরিকল্পনা ভয়ানক। এটি বৃটেনের গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি জনসন সরকারের প্রমত্ততায় হতভম্ব হয়ে গেছি। তারা সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা বলে, কিন্তু তাদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ঠেকাতে পার্লামেন্ট বন্ধ করে দিতে চায়। বেপরোয়াভাবে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। এটা সাংঘাতিক পদক্ষেপ আমাদের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এ জন্যই লেবার পার্টি এই বেপরোয়া সরকারকে থামাতে পার্লামেন্টের সবার সঙ্গে মিলে কাজ করছে। যাতে করে পার্লামেন্টে ইতিমধ্যে প্রত্যাখ্যান হওয়া চুক্তিহীন ব্রেক্সিট পরিকল্পনা থামানো যায়। জনসন যদি নিজের পরিকল্পনা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বা গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরুক।
এদিকে, জনসন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামপ। গুঞ্জন ছড়িয়েছে, জনসনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে আগামী সপ্তাহে একটি অনাস্থা প্রস্তাব তুলতে পারেন করবিন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামপ এক টুইটে জনসনের সমর্থন নিয়ে বলেন, অনাস্থা ভোটে হেরে যাবেন করবিন। কেননা, বৃটেন এতদিন ধরে বরিস জনসনের অপেক্ষাতেই ছিল। জনসন প্রমাণ করে দেবেন যে, তিনি একজন মহান নেতা। এদিকে, বৃটিশ সরকারের সমালোচনায় ইইউ পার্লামেন্টের ব্রেক্সিট বিষয়ক সমন্বয়ক গাই ভেরহফসাদত বলেন, পার্লামেন্ট স্থগিত করে ইইউ-বৃটেনের মধ্যে স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেয়ার এমন অশুভ উদাহরণ আর কখনো দেখা যায়নি।