মো. আমিনুল ইসলাম;;বৃটিশ শাসনামলে নির্মিত ২৮ কক্ষ বিশিষ্ট সাবেক টাউন হলে বিনোদনের নানা আয়োজন হতো। এরপর পাকিস্তান শাসনামলে এই হল রূপ নিয়েছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠা হলো সুনামগঞ্জ কলেজ। সুনামগঞ্জ কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জমি অধিগ্রহণের পর কলেজটি স্থানান্তরিত হলে টাউন হল মার্কেট পরিত্যাক্ত পড়েছিলো দীর্ঘদিন। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে সুনামগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী ও তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের সমন্বিত উদ্যোগে এখানে দৃষ্টিনন্দন অডিটরিয়াম ও পৌর মার্কেট তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। শহরের আলফাত উদ্দিন স্কয়ারের বর্তমান টাউনহল মার্কেটটি এই ইতিহাসের জানান দিলেও বর্তমানে এর করুণ অবস্থা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকার এই ভবনের উন্নয়নের কোন উদ্যোগ নেই। কবে এটি দৃষ্টিনন্দন হবে কেউ জানে না।
প্রাচীণ শহর সুনামগঞ্জে আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে। নতুন নতুন বিপণি বিতানও হচ্ছে। তবে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে’র এই ভবনটি’র হতশ্রী অবস্থা। কেউ এর ভেতরেও ঢুকতে চায় না। ঢুকলেও অবস্থান করার মতো পরিবেশ নেই। অথচ. সরকারি এই জমির উপর দৃষ্টিননন্দন বহুতল বিপণি হলে শহরের সৌন্দর্য বেড়ে যাবে।  টাউনহল মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সালে মহকুমা প্রশাসককে সভাপতি ও পৌরসভার চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘টাউনহল ডেভেলপমেন্ট কাম এক্সিকিউটিভ কমিটি’ গঠন হয়। সিদ্ধান্ত হয় পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা এই পুরাতন টিনশেড ভবন ভেঙ্গে নতুন করে অডিটরিয়াম ও মার্কেট তৈরি করার।  ওই সময়েই পৌরসভার তত্বাবধানে টেন্ডার আহবান হয়, এই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন ৩ হাজারেরও বেশী ব্যবসায়ী। পরে লটারীতে ২৮ কোঠার বরাদ্দ পান ২৮ ব্যবসায়ি।  কিন্তু ১৯৮৪ সালে পৌর চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী খাদ্যমন্ত্রী হবার পর এর কার্যক্রম আর এগোয় নি। ১৫ শতাংশ জমির উপর নির্মিত এই ভবনটি নিয়ে তখন থেকেই জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ঐ সময় থেকে একাধিকবার পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের কাছে দোকান কোঠার লীজ গ্রহিতারা ধরণা দিলেও এর কোন সুরাহা হয়নি।
৪০ বছর পর নতুন করে ‘টাউনহল দোকান মালিক সমিতি’ নামে একটি কমিটি গঠন করেছেন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। জালাল চৌধুরীকে সভাপতি ও মো. শামীম মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি গত ১ মাস ধরে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।  টাউনহল দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম মিয়া দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরকে বলেন তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী যখন ১৯৮৪ সালে মন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন থেকেই প্রশাসন ও পৌরসভার মধ্যে এই মার্কেটটি নিয়ে সমন্বয়হীনতা শুরু হয়েছিলো, আমাদের বলা হয়েছিলো প্রত্যেক দোকান ৯৯ বছরের জন্য ব্যবসায়ীরা বরাদ্দ পাবেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি হয় নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাউন হল মার্কেটের ১৫ শতাংশ জমি জমি জেলা প্রশাসকের এক নম্বর খতিয়ানের ৪৩৩ নম্বর দাগে অবস্থিত। ২০০২ সালে দেওয়ান কামাল রাজা চৌধুরীসহ ৫ জন বাদী হয়ে বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে এই জায়গার স্বত্ত্ব দাবি করে দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য আদালতে স্বত্ব মামলা (৮৯/২০০২) দায়ের করেন। মামলায় বিবাদী করা হয়, নির্বাহী প্রকৌশলী, সড়ক ও জনপথ, চেয়ারম্যান, সুনামগঞ্জ পৌরসভা ও সম্পাদক টাউন হল কমিটি, এবং জেলা প্রশাসক অর্থাৎ টাউন হল কমিটির সভাপতিকে । এই মামলায় এক পর্যায়ে তারা হেরে যান। পরে ২০০৭ সালে জেলা জজ আদালতে স্বত্ব আপিল মামলা (১১২/২০০৭) দায়ের করেন বাদীগণ। এই মামলায় নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন তারা। এই মামলাও নামঞ্জুর হয়। এ মামলার আপিল শুনানী আগামী ১৬ এপ্রিল।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে কর্মরত একজন কর্মচারী জানান, এই ভবনটির দোকানকোঠার যারা দখলে রয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ মালিকানা হাতবদল করেছেন। এটি অনেক সময় আইনসঙ্গতভাবে হয়নি। স্টেশনরোডের বাসিন্দা সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ ধূর্জটি কুমার বসু জানালেন, ১৯৮০ সালের দিকে মহকুমা প্রশাসক আশরাফ হোসেন এবং তৎকালীন পৌর মেয়র ইকবাল হোসেন টাউন হল মার্কেট উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। শহরের বিশিষ্টজনদের নিয়ে টাউন হল মার্কেটের সামনে সভা করেন তাঁরা। সিদ্ধান্ত হয় ওখানে বহুতল ভবন হবে। নীচতলা দোকানকোঠা’র জন্য ভাড়া দেওয়া হবে। দ্বিতীয় তলায় টাউন হল অডিটোরিয়াম থাকবে। এর উপরের তলাগুলো ব্যাংক-বীমা কোম্পানীকে ভাড়া দেওয়া হবে।  উন্নয়ন কার্যক্রম চালানোর জন্য পৌরসভার চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কমিটিও করে দেওয়া হয়। কার্যক্রমও শুরু হয়। কারো কারো কাছ থেকে দোকান কোঠার জন্য ২৫ হাজার টাকা করে নেওয়াও হয়। বর্তমানে যারা দখলে আছেন, তাঁদের কেউ কেউ আছেন ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন, কেউ কেউ আছেন কোন টাকা না দিয়েই দখলে আছেন।
জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন ‘যেহেতু এই ভবনের জমি জেলা প্রশাসকের খতিয়ানে রয়েছে, সেজন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে ইচ্ছে থাকলেও এর উন্নয়নের জন্য হাত দেওয়া যাচ্ছে না। তবে জেলা প্রশাসক চাইলে যৌথভাবে এখানে দৃষ্টিনন্দন একটি শপিংমল করা যায়। বা জেলা প্রশাসন ভবনটি জমিসহ পৌরসভাকে হস্তান্তর করলে পৌরসভা সকলকে নিয়ে এখানে বহুতল বিপণি করার উদ্যোগ নিতে পারে। জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ এ বিষয়ে দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরকে বলেন, এই জমি নিয়ে সম্ভবত মামলা চলমান রয়েছে। কাগজপত্র না দেখে কিছুই বলা যাচ্ছে না, কাগজপত্র যাচাই করে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে হবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn