সিলেটে ইতিহাসগড়া ঝলমলে জয় বাংলাদেশের
রফিকুল ইসলাম কামাল, স্টেডিয়াম থেকে :: এক দশক ধরে বাংলাদেশের মাটিতে কোনো ওয়ানডে ম্যাচে জয় পায়নি জিম্বাবুয়ে। ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের অধিনায়ক চামু চিবাবার কণ্ঠে শোনা গেল, ‘আমরা এই ধারাটা পাল্টাতে চাই।’ সেটা আর হলো কই! অসহায় আত্মসমর্পণে বাংলাদেশের কাছে টানা চৌদ্দতম ম্যাচে পরাজয় বরণ করলো জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশ পেল নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয়। আজ রোববার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটিতে জিম্বাবুয়েকে ১৬৯ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। লিটন দাসের দারুণ এক সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের ৬ উইকেটে ৩২১ রানের পাহাড় ডিঙানো দূরে থাক, মাঝপথই পেরোতে পারেনি সফরকারীরা। ১৫২ রানেই গুটিয়ে যায় তাঁরা। বাংলাদেশের আগের সবচেয়ে বড় জয় ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের ৩২১ রানের জবাবে লঙ্কানরা ১৫৭ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল। টাইগাররা পেয়েছিল ১৬৩ রানের বড় জয়। এবার জয়ের ব্যবধান বাড়লো আরো খানিকটা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও এটা বড় ব্যবধানে জয়ের নতুন রেকর্ড। তাঁদের বিপক্ষে আগের বড় জয়ের রেকর্ড ছিল ১৪৫ রানে, ২০১৫ সালে। ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর। ওইদিনই বাংলাদেশের মাটিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ওয়ানডেত সর্বশেষ জয় পেয়েছিল জিম্বাবুয়ে। এরপর এখন অবধি এখানে জয়ের খোঁজে হয়রান আফ্রিকার দেশটি। আজকের ম্যাচসহ সবমিলিয়ে সর্বশেষ ১৪ ম্যাচেই বাংলাদেশের কাছে হারলো তাঁরা।
জিম্বাবুয়ের জন্য সিলেট ভেন্যু খানিকটা আশার আলো দেখাচ্ছিল। এ ভেনুত্যেই যে ২০১৮ সালে একটি টেস্ট ম্যাচে মুশফিকদের ১৫১ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিল তাঁরা। সেই সুখস্মৃতি নিয়েই আজ ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে নেমেছিল সফরকারীরা। কিন্তু ব্যাটিং ব্যর্থতা তাঁদেরকে পরাজয়ের চোরাবালিতেই ডুবিয়ে রাখলো। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের শুরুটা ছিল কিছুটা সাবধানী। ১০ ওভারে রান আসে ৪০। মন্থর ব্যাটিংয়ে সাবলীল লিটন দাসকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন তামিম ইকবাল। কিন্তু অতি সাবধানী হয়েও রক্ষা হয়নি তাঁর। দলের রান যখন ৬০, ৪৩ বলে ২৪ রান করে কার্ল মুম্বার বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে যান তামিম। ফেরার আগে নষ্ট করে যান রিভিউও। মুম্বার আবেদনে সাড়া দিয়ে আম্পায়ার তামিমকে আউট ঘোষণার পর রিভিউ নেন তিনি। কিন্তু বল ট্র্যাকিংয়ে দেখা যায়, বল আঘাত হানতো মিডল-লেগ স্টাম্পে। তামিম আউটই থাকেন, রিভিউ হারায় বাংলাদেশ। তামিম ফিরে গেলেও উদ্বোধনী জুটিতে তাঁর সঙ্গী লিটন দাস দারুণ সব শটে রানের চাকা সচল রাখেন। ৪৫ বলে ফিফটিতে পৌঁঁছান এই ড্যাশিং ব্যাটসম্যান। ডোনাল্ড তিরিপানোর বলে চার মেরে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৯৫ বলে। ১০টি চার আর ১টি ছয়ে সাজানো ছিল তাঁর দুর্দান্ত এই সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরির পর আরো দ্রুত রান বাড়ানোর তাগিদ দেখা যাচ্ছিল লিটনের ব্যাটে। কিন্তু পায়ের মাংশপেশির টান তাঁকে বেশ ভোগাচ্ছিল। ইনিংসের ৩৬.২ ওভারে মাধেভেরেকে মিড উইকেট দিয়ে উড়ানোর পর আর পারলেন না। মাঠ ছাড়লেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ১০৫ বলে ১৩টি চার আর ২টি ছয়ে ১২৬ রান আসে লিটনের ব্যাট থেকে। তাঁর আগের ক্যারিয়ারসেরা রান ছিল ১২১, ভারতের বিপক্ষে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে।
লিটনের সেঞ্চুরি পূর্ণ করার ওভারেই মুশফিকুর রহিমকে হারায় বাংলাদেশ। তিরিপানোর বলকে থার্ডম্যান দিয়ে খেলতে গিয়ে উইকেটকিপার মুটুম্বামির হাতে ক্যাচ দেন মুশফিক (১৯)। দারুণ খেলছিলেন মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪ হাজার রানও পূর্ণ করেন এই ম্যাচে। তামিম, সাকিব আর মুশফিকের রান ছয় হাজারের বেশি। মাহমুদউল্লাহকে রিভিউ নিয়ে ফেরায় জিম্বাবুয়ে। এমপফুর বলে এলবিডব্লিউর আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার। রিভিউয়ে দেখা যায় বল আঘাত হানতো মিডল স্টাম্পে। ফিরে যান মাহমুদউল্লাহ (২৮ বলে ২টি ছক্কা ও ১টি চারে ৩২ রান)। ক্রিজে যাওয়ার পর থেকেই রান বাড়ানোর দিকে মনোযোগী ছিলেন মোহাম্মদ মিঠুন। দারুণ সব শটে ৫টি চার আর ১টি ছয়ে ৪০ বলে নিজের পঞ্চম ফিফটি তুলে নেন। তবে এমপফুর করা ওই ওভারের পরের বলেই এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে যান তিনি। মেহেদী হাসান মিরাজ এসে টিকতে পারেননি বেশিক্ষণ। ইনিংসের শেষ ওভারে ঝড় তুলেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। গেল বছর জুনে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের পর এই প্রথম ওয়ানডে খেলতে নামা সাইফউদ্দিনের তোপে পড়েন জিম্বাবুইয়ান পেসার ক্রিস এমপফু। তাঁর ওভারের দ্বিতীয়, চতুর্থ আর পঞ্চম বলে ছয় হাঁকানা সাইফউদ্দিন। ওই ওভার থেকে আসে ২২ রান। সাইফউদ্দিন অপরাজিত থাকেন ১৫ বলে ২৮ রানে। বাংলাদেশ করে ৬ উইকেটে ৩২১ রান। এটাই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড। আগের সর্বোচ্চ ছিল ৩২০ রান, ২০০৯ সালে করেছিল বাংলাদেশ।
জিম্বাবুয়ের ক্রিস এমপফু ২ উইকেট পেলেও ১০ ওভারে রান দেন ৬৮। কার্ল মুম্বা ৪৫ রানে ১টি, মুতুমবডজি ৪৭ রানে ১টি, মাধেভেরে ৪৮ রানে ১টি আর তিরিপানো ৫৬ রানে পান ১টি উইকেট। জিম্বাবুয়ের অনভিজ্ঞ ব্যাটিং লাইনআপের জন্য বাংলাদেশের রানের পাহাড় টপকানো ছিল কঠিন কাজ। সেই কাজ বড্ড কঠিনে পরিণত হয়, যখন তাঁদের টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যান দলের স্কোর পঞ্চাশ পেরোনোর আগেই বিদায় নেন। ৮৪ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে ম্যাচে পরাজয়ের ব্যবধানটুকুই কমানোর চেষ্টা করছিলেন জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা। জিম্বাবুয়ের ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই আঘাত হানেন সাইফউদ্দিন। গেল বছর জুনে বিশ্বকাপের পর এই প্রথম ওয়ানডে খেলতে নামা এই পেস বোলিং অলরাউন্ডার ফিরিয়ে দেন টিনাশে কামুনহুকামওয়েকে। ইনসাইড এজে বোল্ড হয়ে ফিরেন এই ওপেনার (১০ বলে ১)। সাইফউদ্দিনই পরে রিভিউ নিয়ে ফেরান রেজিস চাকাভাকে (১৮ বলে ১১)। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বোলিংয়ে এসে ফিরিয়ে দেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক চামু চিবাবাকে। মাশরাফিকে লং মিড অনের উপর দিয়ে উড়াতে যেয়ে মাহমুদউল্লাহর হাতে ধরা পড়েন চিবাবা (২২ বলে ১০)। পাঁচ ম্যাচ আর ২৫৪ বল পর উইকেটখরা কাটালেন মাশরাফি।
বাংলাদেশের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেইলর (১৫ বলে ৮)। তিনিও টিকলেন না বেশিক্ষণ। তাইজুল ইসলামের স্কিড করা বলে মিড উইকেট দিয়ে স্লগ সুইফ খেলতে চেয়েছিলেন টেইলর। কিন্তু ব্যাট আর প্যাডের মধ্যখানের ফাঁক দিয়ে বল ভেঙে দেয় স্টাম্প। সিকান্দার রাজা প্রতিরোধের চেষ্টা করছিলেন। মোস্তাফিজের বাউন্সারে সীমানায় মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ দেন রাজা (৩২ বলে ১৮)। এই ক্যাচ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে আউটফিল্ডে সর্বোচ্চ ক্যাচের রেকর্ড নিজের করে নিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। তাঁর ক্যাচ এখন ৬১টি। পরের স্থানে থাকা মাশরাফির ক্যাচ ছিল ৬০টি। খানিক পরে মাধেভেরের ক্যাচ নিয়ে মাশরাফিও রেকর্ডে ভাগ বসান। উইকেটে জমে গিয়েছিলেন মাধেভেরে (৪৪ বলে ৩৫)। অভিষিক্ত এই অলরাউন্ডার ব্যাট করছিলেন আস্থার সাথে। কাভারে মাশরাফির হাতে তাঁকে ক্যাচ বানান মেহেদী হাসান মিরাজ। কিছুটা আক্রমণাত্মক খেলা রিচমন্ড মুতুম্বামি (১৪ বলে দুই ছয়ে ১৭) রানআউটে কাঁটা পড়েন। তিরিপানো (২), কার্ল মুম্বা (১৩), এমপফু (৯*) কেউই পারেননি প্রয়োজনের দাবি মেটাতে। মুতুমবডজি (৪৭ বলে ২৪) পরাজয়ের ব্যবধানই কমানোর চেষ্টা করেন শুধু। জিম্বাবুয়ে আটকে যায় ১৫২ রানে। বাংলাদেশ জয় পায় ১৬৯ রানে। ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন বাংলাদেশের বোলাররা। সাইফউদ্দিন ছিলেন দুর্ধর্ষ। ৭ ওভারে ২২ রান দিয়ে শিকার করেছেন ৩ উইকেট। মিরাজ ৮ ওভারে ৩৩ রানে ২টি, মাশরাফি ৬.১ ওভারে ৩৫ রানে ২টি, মোস্তাফিজ ৬ ওভারে ২২ রানে ১টি, তাইজুল ৯ ওভারে ২৭ রানে ১টি উইকেট দখল করেন। নিজের দ্বিতীয় উইকেট শিকারের মধ্য দিয়ে মাশরাফি অধিনায়ক হিসেবে শততম উইকেটের রেকর্ড গড়েন।