মালয়েশিয়ায় নাটকীয়তা শপথ নিলেন মুহিদ্দিন
জাহিদুর রহমান- মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে নাটকীয়তা জেঁকে বসেছিল গত কয়েক সপ্তাহ থেকেই। সে নাটকীয়তায় হতবাক হয়েছে পুরো বিশ্ব। শনিবার তা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। সবার প্রত্যাশা চুরমার করে দিয়ে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নিজ দলের সভাপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুহিদ্দিন ইয়াসিনের নাম ঘোষণা করেন দেশটির রাজা। গতকাল রাজা ইয়াং ডি-পার্তুয়ান আগোং আল সুলতান আবদুল্লাহ রিয়াতুদ্দিন আল মুস্তাফা বিল্লাহ শাহ’র কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেছেন মুহিদ্দিন। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন মাহাথির। তবে দেশটির রাজনীতিতে নাটকীয়তার অন্ত হয়নি এখনো। হাল ছাড়েননি মাহাথির। কিন্তু যে সংকট ও অস্থিতিশীলতা ঘিরে ধরেছিল মালয়েশিয়ার রাজনীতিকে, অল্প সময়ের জন্য হলেও তা বিরতি নিয়েছে।
মাহাথিরের উত্থান ও উৎখাত
৯৪ বছর বয়সী মাহাথির শুধু মালয়েশিয়ার সবচেয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদই নন, বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গত সপ্তাহ পর্যন্ত। দেশটির রাজনীতিতে একচ্ছত্র দখল ছিল তার। ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটানা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মালয়েশিয়া শাসন করেছেন তিনি। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী তিনি। অবসরে গিয়েছিলেন রাজনীতি থেকে। ২০০৩ সালে তার অনুপস্থিতিতে দেশ শাসন শুরু করে তারই শিষ্য নাজিব রাজাক। কিন্তু তার শাসনামলে দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে শিষ্যকে হারাতে ফের মাঠে নামেন মাহাথির। হাত মেলান একসময়কার সহকারী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে, যাকে তার সরকার সমকামিতার অভিযোগে কারাগারে পাঠিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দার সময় মাহাথিরের সঙ্গে এক মতবিরোধের জেরেই কারাগারে পতিত হন আনোয়ার। কিন্তু সেসব ভুলে মাহাথিরের সঙ্গে হাত মেলান আনোয়ার। দুজন মিলে ‘হারাতান পাকাতান’ জোট গঠন করেন। নির্বাচনে জিতলে আনোয়ারকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন মাহাথির। এমন কী দুই বছর পর তার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন। নির্বাচনে জেতেনও। মালয়েশিয়ার রাজনীতির ইতিহাসে সৃষ্টি করেন নতুন অধ্যায়। নিজের প্রথম প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে আনোয়ারকে মুক্ত করেন মাহাথির। কিন্তু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে টান পড়ে। সৃষ্টি হয় জটিলতা। নিজের দল থেকে পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন। কিন্তু তাকেই অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন রাজা। তবে তাতে জটিলতার অবসান ঘটেনি। সে জটিলতা কাটিয়ে ওঠার আগে নিজেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ প্রধানমন্ত্রী। মালয়েশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে স্বল্পমেয়াদি প্রধানমন্ত্রীর নামটিও তার হয়ে ওঠে।
মালয়েশিয়ার ইতিহাসে মাহাথির এক অনবদ্য রাজনীতিক। কিন্তু এখন তাকে ছাড়াই ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা করছে দেশটি। শনিবার রাজা আগোং এক ঘোষণায় জানান, সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদের সমর্থন নেই মাহাথিরের প্রতি। তার জায়গায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হন মালয়েশিয়ার ঝানু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক মুহিদ্দিন। দু’বছর আগে মাহাথির যে দুর্নীতিগ্রস্ত দলকে পরাজিত করেছিলেন তাদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছেন তিনি। রাজনীতির খেলায় হারিয়েছেন মাহাথিরকে। মাহাথির জানান, বহুদিন ধরেই এ পরিকল্পনা করছিলেন মুহিদ্দিন। মালয়েশিয়ার নাটকীয় রাজনীতির সুতায় এমন পাক বিশ্লেষকদেরও হতভম্ব করে দিয়েছে। গত সোমবার মাহাথিরের পদত্যাগের পর থেকে তীক্ষ্ণ মোড় নেয় চলমান নাটকীয়তা। একের পর এক রাজনীতিকরা নিজ দল ছেড়ে অন্যদলে যোগ দেন, ফের সে দল ছেড়ে অন্যদলে। প্রতি ঘণ্টায় রাজনীতির পটভূমি পাল্টে যেতে থাকে। শনিবার সকাল পর্যন্ত সকলের প্রত্যাশায়, জয়ী হতে যাচ্ছিল মাহাথিরের জোট হারাতান পাকাতানই। কিন্তু তখনও চলছিল দল পরিবর্তনের খেলা। সে খেলা শেষে রাজা মাহাথিরের বদলে মুহিদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। ৭২ বছর বয়সী মুহিদ্দিন নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, আমি আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করতে চাই।
ক্ষমতায় ফিরছেন নাজিব রাজাক
মুহিদ্দিন জানান, তার নীতি হছে ‘মালয় ফার্স্ট’। কয়দিন আগ পর্যন্ত তার দল মালয়েশিয়ান ইউনাইটেড ইনডিজেনিয়াস পার্টির (এমইউআইপি) নেতৃত্ব ছিল মাহাথিরের হাতে। কিন্তু হারাতান পাকাতানে যখন ভাঙন ধরে, তখন মাহাথিরের পাশ ছেড়ে তার বিরোধী দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) সঙ্গে যোগ দেয় এমইউআইপি। এখানে উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে অবসরে যাওয়ার আগে মাহাথির ও মুহিদ্দিন উভয়েই ইউএমএনও’র শীর্ষ নেতা ছিলেন। নাজিব রাজাকের হাতে দলটির ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে যান তারা। রোববার মুহিদ্দিনকে অভিনন্দন জানিয়ে নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছেন নাজিব। অন্যদিকে প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন মাহাথির। শনিবার সকালে তিনি জানান, তিনি কখনোই ইউএমএনও’র সঙ্গে হাত মেলাতেন না। হেরে গেলেও না। মুহিদ্দিন যেহেতু ইউএমএনও’র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, তার মানে হচ্ছে, নাজিব রাজাক ফের ক্ষমতায় ফিরছেন। তার বিরুদ্ধে দেশটিতে রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপব্যবহারের অভিযোগে তদন্ত চলছে। তার ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে আতঙ্কিত দেশটির সংস্কারবাদী ও হুইসেলব্লোয়াররা। নাজিবের অনেক সহযোগী দল মালয়েশিয়াকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তাদের ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে ভীত চীনা সংখ্যালঘু আদিবাসীরাও। মালয়েশিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের দেশ হলেও, সেখানকার জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ চীনা ও ভারতীয়। মাহাথিরের জোট এই সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম রাজনৈতিক দল ছিল।
এখনো নাটকীয়তা বাকি
শনিবার সকাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হারাতান পাকাতানের মনোনীত প্রার্থী ছিল আনোয়ার ইব্রাহিম। মাহাথিরের একসময়কার ঘনিষ্ঠ সহযোগী তিনি। কারাগারে পতিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকেই মাহাথিরের উত্তরসূরি মনে করা হতো। এবার মুক্ত হওয়ার পর তার হাতেই মাহাথিরের ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার কথা। কিন্তু সামপ্রতিক জটিলতার মাঝে মুহিদ্দিন ও ইউএমএনওকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে মাহাথিরই বেশি প্রভাবশালী প্রার্থী। সেকথা বিবেচনায় নিয়েই আরো একবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন থেকে পিছিয়ে যান আনোয়ার। শনিবার সকালে জানান, তিনি পিছু হটছেন। যাতে করে, মালয়েশিয়া ফের দুর্নীতিগ্রস্তদের হাতে না পড়ে।
আনোয়ারের ঘোষণার পর রোববার মাহাথির জানান, তার বিশ্বাস এখনো তার প্রতিই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদের সমর্থন রয়েছে। তিনি সরকার গঠন করতে সক্ষম বলে দাবি করেন। কিন্তু এর এক ঘণ্টার মধ্যেই মুহিদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
মাহাথির হাল ছাড়েননি। আগামী ৯ই মার্চ নতুন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পার্লামেন্ট বসবে। সেদিন মুহিদ্দিনের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব তোলার কথা জানিয়েছেন মাহাথির। নাটকীয়তার এ পর্যায়ে এসে মাহাথিরের সুযোগ কতটা তা বলা কঠিন। কিন্তু এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মালয়েশিয়ান তাকে সে সুযোগের দাবিদার মনে করে। হোক তার বয়স ৯৪। হোক তিনি রাজনীতির লড়াইয়ে আহত এক সেনাপতি। এখনো তিনি লড়াইয়ের অযোগ্য হয়ে পড়েননি।