ইসরায়েলি সিমন আর বাংলাদেশি সাদিয়ার বিশ্বাস ভঙ্গের গল্প
বার্তা ডেস্ক :: ইসরায়েলি এই যুবক ডেটিং-অ্যাপ ‘টিন্ডারের’ মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামর্থ্যবান তরুণীদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতান। নিজেকে পরিচয় দেন বিরাট ধনী হিসেবে। এরপর পরিচয় হওয়া নারীদের সঙ্গে তিনি ডেটিং শুরু করেন। ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে তাদের নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ান। বিলাসবহুল হোটেলে থাকেন। সঙ্গে রাখেন ভাড়া করা বডিগার্ড। ভুয়া ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও ব্যবসায়িক সফরসঙ্গী। একেকজন নারীর সঙ্গে মাসের পর মাস বা বছর অবধি এই সম্পর্ক গড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন বিপদের কথা বলে প্রেমিকাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা ধার করতে শুরু করেন। তাকে উদ্ধারের জন্য কেউ কেউ ব্যাংক ঋণ করেও কয়েক কোটি টাকা ধার দেন। যেমন নরওয়ের সিসিলিয়ে। সিমনের জন্য তিনি দশটি ব্যাংক থেকে ঋণ করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই টাকা পরিশোধের ভুয়া ডকুমেন্ট পাঠান সিমন সেসিলিয়ের কাছে। এর মধ্যেই সিমন পার্নিলা খয়াহোলম নামের আরেক সুইডিশ তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কের ভিত গড়তে শুরু করে দিয়েছেন টিন্ডারে।
ভিজির অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেসিলিয়ের পাঠানো টাকা থেকে সিমন পার্নিলাকে চার লাখ ক্রোনা আর সেই সঙ্গে ব্যাংকক যাওয়ার টিকেট কিনে পাঠিয়েছিলেন। সেসিলিয়ে কিংবা পার্নিলা যতক্ষণে তার অভিসন্ধি আঁচ করতে পারেন ততক্ষণে একজনকে ছেড়ে আরেকজনের সঙ্গে ডেটিং শুরু করেন সিমন। নতুন প্রেমিকার জন্য একই উপায়ে বিছান প্রতারণার জাল। কয়েক বছর ধরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন দেশের একাধিক নারীকে এমন অভিনব প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন সিমন। ২০১১ সালেই ইসরায়েলে তার বিরুদ্ধে চুরি, জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলা হয়েছিল। কিন্তু গোটা ইউরোপ চষে বেড়ানো এই সিমনের টিকির দেখাও পাচ্ছিল না দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৫ সালে ফিনল্যান্ডে তিন নারীর সঙ্গে প্রতারনায়ও অভিযুক্ত হন তিনি। শুধু ইসরায়েল বা ফিনল্যান্ড নয় সিমনকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল সুইডেন, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক আর নরওয়ের পুলিশও। অবশেষে তিনি ধরা পড়েন ২০১৯ সালের জুনে গ্রিক পুলিশের হাতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এক নারীকে গ্রেপ্তার করে। তার ছদ্মনাম জান্নাতুল ফেরদৌস। আসল নাম সাদিয়া জান্নাত। সাংবাদিক সম্মেলনে সিআইডির দেয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫-৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সিমনের ফাঁদ পাতার মাধ্যম ছিল টিন্ডার অ্যাপ। আর সাদিয়ার ছিল সংবাদপত্রে কানাডা প্রবাসী ধণাঢ্য নারীর জন্য ‘ধার্মিক ও সুপাত্র’ চেয়ে বিজ্ঞাপন। বিয়ের পর সেই পাত্র পাবেন কানাডায় বসবাসের সুযোগ। এই বিজ্ঞাপন দেয়ার পর সাদিয়াকে তার সম্ভাব্য ‘পাত্রদের’ পিছনে সিমনের মতো তেমন বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হয়নি। উন্নত দেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্নে বিভোর যুবা, এমনকি বৃদ্ধরাও এসে ধরা দেন তার জালে। উল্টো তারাই কাড়ি কাড়ি টাকা তুলে দেন তার হাতে। হয়ে যান সর্বস্বান্ত।
তার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ ৭০ বছর বয়সি ঢাকার এক ব্যবসায়ীর প্রতারিত হওয়ার কাহিনি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত বর্ণনা অনুযায়ী কানাডায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে তিন দফায় টাকা নেন সাদিয়া। ভিসা আবেদনের জন্য দেড় লাখ, ভিসার জন্য ৭০ হাজার, ট্রাভেল ডকুমেন্টস তৈরির জন্য ছয় লাখ, কানাডার সোশ্যাল সিকিউরিটির জন্য ৬০ লাখ টাকা তুলে দেন তিনি। টাকা দেয়ার কিছুদিন পর সাদিয়া ঐ ব্যক্তিকে বলেন কানাডায় অনেক শীত, যে কারণে তিনি থাকতে পারবেন না। তার চেয়ে সাদিয়া তার নিজের ২০০ কোটি টাকাও কানাডা থেকে নিয়ে আসবেন। বিয়ে করে দু’জনে ঢাকাতেই বসবাস করবেন। এরপর শুরু হয় ঐ ব্যক্তির এবং সাদিয়ার কথিত টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া।
এজন্য আরো তিন ধাপে সাদিয়াকে ২৩ লাখ, ৭২ লাখ ও ১০ লাখ টাকা দেন ব্যবসায়ী। একসময় সাদিয়া তাকে ২০০ কোটি টাকা দেয়ার কথা বলে একটি প্যাকেট তুলে দেন। বাসায় নিয়ে খোলার পর যেখানে পেয়েছেন ‘এ-ফোর সাইজের ৫০০ টি সাদা কাগজের একটি বান্ডিল’। এর মধ্যেই মোট এক কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নাই হয়ে গেল সত্তরের প্রৌঢ় ব্যবসায়ীর। সিমন আর সাদিয়া বিশ্বের দুই প্রান্তের দুই জন। তাদের প্রতারণার ধরনে আছে অনেক মিল আবার অনেক অমিলও। সিমন এক প্রেমিকার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আরেক প্রেমিকার পেছনে খরচ করেন। নিজেও বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। সাদিয়ার কোনো বিনিয়োগ বা দেয়া-নেয়া নেই। পুরোটাই আত্মসাৎ করেন। সিমনের প্রেমিকারা ভালোবেসে প্রেমিককে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য টাকা দেন। আর সাদিয়ার ‘পাত্ররা’ তাকে টাকা দেন বিদেশে পাড়ি জমিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। একটি কাহিনির চরিত্ররা ইউরোপের উন্নত দেশের আরেকটি এশিয়ার স্বল্পোন্নত (জাতিসংঘের তালিকায়) কিংবা স্বল্প মধ্যম আয়ের দেশের (বিশ্বব্যাংকের তালিকা)। যেখানে ৭০ বছরের একজন অবস্থাসম্পন্ন ব্যবসায়ীও বিদেশ পাড়ি জমাতে চান, প্রয়োজনে কাউকে বিয়ে করে হলেও।
শুধু পাত্র চাই বিজ্ঞাপন নয়, ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে, পত্রিকায়, লিফলেটে সহজে কানাডা-অ্যামেরিকা, ইউরোপ যাওয়ার লোভনীয় অফার চলে। সেই অফারে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত থাকেন কত হাজার, লাখোজন। কত রকমের প্রতারণা যে পথে পথে তাদের অপেক্ষায় থাকে তার খবর প্রায়ই মিলে। ইউরোপের স্বপ্ন থেমে যায় লিবিয়ায় কিংবা ভূমধ্যসাগরে। অনেকের পরিবার সর্বস্বান্ত হয় বন্দিদের জন্য দালাল, দস্যুদের মুক্তিপণের অর্থ দিতে দিতেই। মালয়েশিয়ার স্বপ্ন আটকে যায় অনেকের থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ভিয়েতনাম কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেউ নিঃস্ব হয়ে ফিরলে বিহিত না করে রাষ্ট্রও যেন আরেক দফা প্রতারণা করে। প্রতারকদের না ধরে ভুক্তভোগীদেরই জেলে পোরে। বিশ্বাস ভঙ্গের ফাঁদ ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার, হাত ধরাধরি করেই যেন আছে।