এমসি কলেজর ধর্ষন মামলাঃ ফেসে যেতে পারেন বাদী!
সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বড় ধরনের ‘ত্রুটি’ পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্নিষ্ট সূত্রমতে, সাধারণত মামলার এজাহারে এ ধরনের ভুলের সুযোগ নিয়ে আসামিপক্ষ বিচারে সময়ক্ষেপণের সুযোগ নিয়ে থাকে। স্ত্রীকে ধর্ষণের কথা উল্লেখ করে শাহপরাণ থানায় মামলা করেছেন তার স্বামী। সেখানে নির্যাতনের শিকার স্ত্রীর প্রকৃত নাম গোপন করা হয়েছে। এমনকি জন্মনিবন্ধন সনদ ও বিবাহ-সংক্রান্ত নথিতে ওই তরুণীর যে নাম রয়েছে, মামলায় সেই নাম পুরোপুরি চেপে যাওয়া হয়েছে। এজাহারে তরুণীর প্রকৃত নাম গোপন করার বিষয় নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।এজাহারে দেখা যায়, এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ছয়জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও দু-তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীর স্বামী। এজাহারে অভিযুক্তদের অধিকাংশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
এদিকে, চাঞ্চল্যকর এ ধর্ষণের ঘটনায় সংগৃহীত কিছু তথ্য, ফোনালাপ ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্নেষণ করে সংশ্নিষ্টরা ধারণা করছেন, এ ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত আইনুদ্দিনের সঙ্গে একটি মোবাইল নম্বরে ফোনালাপের কথোপকথন খুবই রহস্যজনক। কাহিনি ভিন্নদিকে মোড় নিতে পারে, যেটি এ ঘটনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, এ ঘটনার মূল কেন্দ্রে রয়েছেন আইনুদ্দিন, তারেকুল ইসলাম তারেক, রাজন, অর্জুন লস্কর ও এক নম্বর আসামি সাইফুর রহমান। আইনুদ্দিনের একাধিক ফোনালাপ ও ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্নেষণ করে চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত মিলেছে। সিসিটিভিতে দেখা যায়, ঘটনার দিন সিলেটের টিলাগড়ের একটি বাসার সামনে সাইফুল, তারেক, রাজন ও আইনুদ্দিন আশপাশে ছিলেন। ফুটেজে সেখানে ঢাকা মেট্রো-ভ-০২১৩৬২ একটি গাড়ি আসতে দেখা যায়। ওই গাড়ির কথা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ছাত্রাবাসে ন্যক্কারজনক ঘটনার আগে টিলাগড় এলাকায় কেন ওই গাড়ির আনাগোনা- এটা নিয়ে রহস্য ও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত বের করতে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। এ মামলার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট অনেকের সঙ্গে সমকাল একাধিক দফায় কথা বললেও ধর্ষণের মামলা হওয়ায় সংগত কারণে সবার নাম-পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে। তবে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ড সমকালের হাতে রয়েছে।
এজাহারে ভিন্ন নাম উল্লেখ করে মামলা করার ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহপরাণ থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, বাদী যে নামের কথা বলেছেন, সেই নামই এজাহারে লেখা হয়েছে। সেটা ভুল হয়ে থাকলে তদন্ত কর্মকর্তা শুধরে নেবেন। নামের ভুলের দায় পুলিশের নয়। এটা বাদীর দায়। ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীর স্বামী জানান, তার স্ত্রীর আসল নাম এজাহারে লেখেননি তিনি। একটি নামে তার স্ত্রীকে কেউ কেউ ডাকেন। এজাহারে সেই নাম লিখে দিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেন, মামলার এজাহার একটি আইনি প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপ। অবশ্যই স্ত্রীর প্রকৃত নাম তার লেখা উচিত ছিল। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ন্যক্কারজনক ঘটনার আগে স্ত্রীকে নিয়ে ওই দিন কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্পষ্ট কোনো উত্তর দেননি তিনি। পরে সবকিছু জানানোর কথা বলে ফোন বন্ধ করে দেন। এদিকে মামলার বাদীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার ছেলে কাউকে বিয়ে করেছে- এটা তার জানা ছিল না। ছেলে কাউকে বিয়ে করেছে- এটা পরিবারের অন্য সদস্যরাও জানে না। আট/নয় মাস ধরে বাড়ির সঙ্গে ছেলের কোনো যোগাযোগ নেই। সিলেটে কোথায় থাকে, কী করে তা-ও জানা নেই তার। ঘটনার পরও ছেলে বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
বাদীর বাবা আরও জানান, তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে সংসারের জন্য আয়-রোজগার না করায় সিলেটে ছিল। তবে ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীর বাবা জানান, ছেলের বাবা এ বিয়ের বিষয়ে কেন কিছু জানেন না বলে দাবি করলেন- সেটা তিনি ভালো বলতে পারবেন। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এদিকে যে প্রাইভেটকারে এমসি কলেজে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটির মালিকানা নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। ঢাকা মেট্রো-ভ-০২১৩৬২ নম্বরের এই প্রাইভেটকারটির মালিক হিসেবে নাম রয়েছে হাজি মো. আব্বাস আলীর। বিআরটিএ থেকে পাওয়া গাড়ির তথ্য অনুযায়ী আব্বাসের ঠিকানা সাভারের ইমানদারপুর। ২০১৬ সালের পর এই গাড়ির কোনো কাগজপত্র নবায়ন করা হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার বাদী জানান, গোলাপগঞ্জের অনিক নামের একজনের কাছ থেকে গাড়িটি কিনেছেন তিনি। তবে গাড়ির মালিকানা বদল করেননি এখনও।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, কী উদ্দেশ্যে এজাহারে অন্য নাম দেওয়া হয়েছে, সেটা তদন্ত কর্মকর্তা খতিয়ে দেখতে পারেন। চার্জশিট দেওয়ার সময় আসল নাম-ঠিকানা তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করবেন। সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার জ্যোতির্ময় সরকার বলেন, ঘটনার পর একে একে সব আসামি ধরা হয়েছে। এখন আমরা মূল তদন্তে মনোনিবেশ করছি। ঘটনার আগে-পরে কী রয়েছে এবং নেপথ্যে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে কিনা, তার নিবিড় তদন্ত চলছে।