এ মাসেই সিলেট এসেছিলেন প্রতারক সেই ‘নবাব’, গিয়েছিলেন রায়হানের বাড়িতেও
নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর পরিচয় দিয়ে কোটি কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে আলী হাসান আসকারী নামের এক ব্যক্তিকে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি)। গ্রেপ্তারের পর থেকে এই ভূযা নবাবের প্রতারণার কাহিনী উঠে আসছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। ভূক্তভোগীদের অনেকেই প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ করছেন। নবাবের বংশধর ও প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে প্রতারণা করা আলী হাসান আসকারী সম্প্রতি সিলেটেও এসেছিলেন। সিলেটে একটি হোটেলে ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে নৈশভোজ করেন। সিলেটে এসে তিনি পুলিশী নির্যাতনে খুন হওয়া রায়হানের আহমদের বাড়িও যান।
জানা যায়, গত ১৬ অক্টোবর সিলেটে আসেন প্রতারণার দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া আলী হাসান আসকারী। সিলেটে এসে তিনি দরগা গেইট এলাকার একটি হোটেলে উঠেন। এরপর শাহজালাল (র.) মাজার জিয়ারত করেন। রাতে জনপ্রতিনিধি ও কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতার সাথে ওই হোটেলে নৈশভোজে অংশ নেন তিনি। এরআগে যান নগরীর আখালিয়া এলাকার রায়হানের বাসায়। এসময় সিলেট সিটি করপোরেশনের ২০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, স্থানীয় কাউন্সিলর মখলিসুর রহমান কামরান ও বিশিষ্ট ব্যবসাযী আতাউল্লাহ সাকের উপস্থিত ছিলেন। রাতে আলী হাসান আসকারীর সাথে নৈশভোজে অংশ নেন কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতি সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি জুবায়ের আহমদ চৌধুরীসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা। র্যাবের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও এই নৈশভোজে অংশ নেন। আলী হাসান আসকারী নিজের ফেসবুক পেজে এই নৈশভোজ, রায়হানের বাড়িতে যাওয়াসহ সিলেট সফরের বিভিন্ন ছবি পোস্ট করেন।
আলী হাসান আসকারীর সাথে পরিচয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুক্রবার (৩০ অক্টোবর) পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতি সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি জুবায়ের আহমদ চৌধুরী বলেন, আমরা তাকে চিনি না। ওই রাতে দরগাহ গেইট এলাকার হোটেল স্টার স্পেসিফিকে আমাদের একটি অনুষ্ঠান ছিলো। সেখানেই তার সাথে পরিচয়। কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ তাকে ‘নবাব সলিমুল্লাহর নাতি’ বলে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর আমরা একসাথে নৈশভোজে অংশ নেই।
সিলেটের কেউ আলী হাসান আসকারীর প্রতারণার শিকার হয়েছেন কী না এমন কোনো তথ্য জানা নেই বলে জানান জুবায়ের। রায়হানের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দেওয়ার কিছু ছবি নিজের ফেসবুকে পোষ্ট করেছেন আলী হাসান আসকারী। এতে তার সাথে উপস্থিত অন্যদের নাম লিখতে গিয়ে কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদকে সম্বোধন করেছেন ‘বন্ধু’ হিসেবে। এ ব্যাপারে কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাজ্যে আছেন বলে তার ঘণিষ্টজনরা জানিয়েছেন।পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নিজেকে নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজের ফুপু পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করতেন আলী হাসান আসকারী।
তাকে গ্রেপ্তারের পর সিটিটিসির ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আসকারী একজন ভয়ঙ্কর প্রতারক। সে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। নবাবের বংশধর হিসেবে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে সে এসব প্রতারণা করতো। প্রতারণার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ফুপু বানিয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের নামও ভাঙিয়েছে। আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছি। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তার প্রতারণার আরও কৌশল জানা ও প্রতারণা করে আয় করা অর্থ কোথায় পাচার করেছে, তা জানার চেষ্টা করছি।’
পুলিশ জানায়, বছর পাঁচেক আগে নিজের নামের সঙ্গে খাজা শব্দটি যোগ করেন আলী হাসান আসকারী। নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর খাজা আমানুল্লাহ আসকারীর ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন এই প্রতারক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেকে নবাবের বংশধর হিসেবে প্রচারণা শুরু করেন। একইসঙ্গে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রোগ্রামে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেন। সেসব ছবি প্রচার করতেন ফেসবুকে। এগুলো ছিল প্রতারণার হাতিয়ার। প্রতারণার কাজে ১০-১২ জনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি চক্র। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করতেন। তারপর কৌশলে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন আসকারী। নিজের বিত্ত-বৈভব ও নবাবের বংশধর পরিচয় দিয়ে খাতির জমাতেন। তার বাবার প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ৭০০ নার্স নিয়োগ করা হবে জানিয়ে কর্মী দিতে বলতেন। নবাবের বংশধর হিসেবে অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন। টাকা নেওয়ার পরপরই তাদের ফোন আর ধরতেন না। মোবাইল নম্বর ব্লকলিস্টে রাখতেন। কেউ বাড়াবাড়ি করতে চাইলে হত্যার হুমকিও দিতেন।
পুলিশ জানায়, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নার্স নিয়োগের নামে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন। এছাড়া পোলান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর নামেও টাকা নিয়েছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার নাম করেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার নাম ভাঙাতেন তিনি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসকারী স্বীকার করেছেন, তার এই প্রতারণার কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগী ছিল রাশেদ ওরফে রহমত আলী ওরফে রাজা, মীর রাকিব আফসার, সজীব ওরফে মীর রুবেল, আহাম্মদ আলী ও বরকত আলী ওরফে রানা। এরমধ্যে রাশেদ, আহাম্মদ ও বরকত আপন তিন ভাই। বড় ভাই আহাম্মদ তার ম্যানেজার ছিল। রাশেদকে বানাতেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। আর ছোট ভাই বরকত ছিল তার বডিগার্ড। ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের একজন কর্মকর্তা জানান, আসকারী নিজের সম্পর্কে এমনভাবে প্রচারণা করতো যে সাধারণ মানুষ সহজেই তাকে বিশ্বাস করে ফেলতো। প্রতারণার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সামনে পিন্টুর মাধ্যমে কয়েকজন যুবকসহ নবাব আসকারীর অনুসারী হিসেবে একটি সংগঠনের ছবি তুলে তা ফেসবুকে প্রচার করেছে। মালয়েশিয়াতেও তার নামে সংগঠন রয়েছে বলে ব্যানার বানিয়ে কয়েকজন যুবকের মাধ্যমে কয়েকটি ছবি তুলে তা প্রচার করেছে।