তুলিকা ঘোষ চৌধুরী–
যুগ হতে যুগান্তরে রয়ে যাওয়া কিছু নাম। ক্ষনেক্ষনে বারেবারে উঁকি দিয়ে উঠে তাহা । কভু মুছে না যে সে নাম। মুহাম্মদ আব্দুল হাই তেমনি একটি নাম। তেমনি একটি ইতিহাস। আব্দুল হাই স্যারকে আমি দেখিনি। তবে জেনেছি। শুনে শুনে এক সময় তাকে নিয়ে ভেবেছি। জানা আর ভাবানা দুই মি্লিয়ে আজ তাকে নিয়ে লিখা। ‘সময়ের স্মৃতিতে বহুমাত্রিক প্রতিভা মুহাম্মদ আব্দুল হাই’ গ্রন্থের সম্পাদক ইমানুজ্জামান মহী ভাই যখন গ্রন্থের জন্য এই গুণিজনকে নিয়ে লিখতে বলেন, লোভটা সামলাতে পারলাম না। আমি শিক্ষক এবং সংগীত শিল্পী। একজন শিক্ষক এবং একজন শিল্পী কে নিয়ে কিছু লিখবো সেতো আমার ভাগ্য। ছোট ভাই আবু সালেহের প্রেরনা ও তাগাদায় লিখতেই হলো। একজন শিল্পীর ও একজন শিক্ষকের দৃষ্টিতে আমি তাকে দেখার চেষ্টা করি। দৃষ্টিতে আমি যাই দেখি না কেনো মুহাম্মদ আব্দুল হাই শুধু তাই ছিলেন না । আমি তাকে একজন শিক্ষক ও শিল্পী হিসাবে শুধু বিচার করিনা। তাই যদি করি তাহলে তার প্রতি অবিচার হবে। তিনি শুধু শিক্ষক কিংবা একমাত্র সংস্কৃতির ধারক ছিলেন না। একাধারে ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের শ্রেষ্ট সন্তান। একজন ভাষা সৈনিক। স্বদেশ প্রেমিক। একজন রাজনীতিবিদ। অন্যায়ে আপোষহীন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলিষ্ট কণ্ঠস্বর। একজন সাংবাদিক। সমাজের দর্পণ। একজন কবি। ভাবুক। একজন সুর শিল্পী। প্রেমময় এক উদার আকাশ। অতল জলের আহ্বান। সমাজের বাতিঘর। জ্ঞানে প্রজ্ঞায় সৃষ্টিতে শ্রুতিতে উজ্জ্বল প্রোজ্জ্বল এক শিখা চিরন্তন। একের ভেতরে যার এতো রূপ। এতো প্রকাশ। ক্ষণজন্মা’। অসম্ভব এই সুন্দর শব্দ। নামের পূর্বে তাঁর বসানোটাই বেশী মানায়।
করি তাঁর শেকড়ের সন্ধান:- নাম- মুহাম্মদ আব্দুল হাই । সুনামগঞ্জ পৌরসভার অন্তর্গত আরপিননগর নামক স্হানে জন্মনেন ১৯২৭ খ্রীঃ ২৩ মে । পিতা-আব্দুস সামাদ চৌধুরী। মাতা- জহুরুন নেছা। মুহাম্মদ আব্দুল হাই যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, পরিবারটি পরম্পরায় মুসলিম সংস্কৃতির ধারক একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার। তিন ভাই বোনের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সূচনা আরপিননগরস্হ কে.বি মিয়া মক্তবে। আর সমাপন করেন ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়ার মাধ্যমে।
একের ভেতর বহু রূপের প্রকাশ। একজন আব্দুল হাই। যিনি একাধারে মুক্তিযোদ্ধা। ভাষা সংগ্রামী। রাজনীতিবিদ। সাংবাদিক। শিক্ষক। লেখক। সাংস্কৃতিক সংগঠক। গীতিকবি। নানাবিধ কর্মকাণ্ডে উৎসর্গীত করা মানুষ। দেশ। সমাজ ও মানুষকে ভালোবাসার ব্রত ছিলো যার লক্ষ। নিজেকে নিমগ্ন রেখেছিলেন যিনি বহুমাত্রিক ধারায়। শ্রদ্ধেয় সেই আব্দুল হাই সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাঁকে চিনতে চেষ্টা করেছি। জানতে চেষ্টা করেছি। স্যারের কর্মময় জীবন পাঠ করেছি। জীবন ছিলো তাঁর বহতা নদী মতো। চলছে তো চলছে নিরবধি। রোজনামচা পড়তে পড়তে জানা হলো তার যৌবনের সেই উদ্দামতার কথা। মানবতার টানে সেই যৌবনে নেমেছিলেন রাজপথে। মিছিলে মিটিংয়ে প্রতিবাদী ভূমিকায়। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে । রাষ্ট্রভাষা বাংলা কায়েমের স্বপক্ষে। দেশ মাতৃকার ডাকে গিয়েছেন যুদ্ধে। জেল কেটেছেন। রাজনীতির কারনে বহিস্কৃত হয়েছেন কলেজ থেকে। বাংলায় কথা বলা শিখিয়েছেন। দেখিয়েছে ভাষার মুখ। আজ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার মুখ আমি তাদের জন্য দেখি। তাদের দেয়া কথায় আমি আজ কথা বলি। গাই বাংলায় গান। কন্ঠে বাজে দোয়েল শ্যামা সুর। কথা যবে বলি, বারবার তাই তাদের কথা ভাবি। ‘আজ লিখছি। কথা বলছি। সেতো তাদেরই দান। কথা দিচ্ছি । প্রতিশ্রুতি করছি। রাখবো তোমাদের মান।‘
ভাষাযোদ্ধা আব্দুল হাইকে নিয়ে যদি ভাবি মনে হয় সত্যিকার অর্থে তিঁনি এক সৈনিক। একজন শিক্ষক ভাবলে মনে হয়-বাতিঘর। রাজনীতিবিদ ভাবলে পাশাপাশি ভাবতে হয় একজন দেশপ্রেমিক। প্রতিবাদে বলিষ্ট কণ্ঠস্বর। যদি ভাবি তিঁনি সাংবাদিক,তার সাথে জুড়ে দিতে হয় সেই শব্দ ‘সমাজের দর্পণ। যদি ভাবি তিনি কবি, ভাবতে হয় তখনই তিঁনি ভাবরসে টুইটুম্বর একজন!!m বহুমাত্রিক যুদ্ধা স্যার আব্দুল হাইকে নিয়ে আমার লিখার দুটো কারণ। যে কারন দু’টো আমিও তিনি। দু’জনের মাঝে অনেকটা মিলে যায়।
(১) পেশায় তিঁনি ছিলেন শিক্ষক। আমিও আমার ক্ষুদ্র জীবনে এই মহান পেশাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছি।
(২)স্যার আব্দুল হাই একজন সংস্কৃতি কর্মী ছিলেন। সংস্কৃতির সুস্হ ধারাকে বেগবান করতে তিনি একসময় সুনামগঞ্জ আর্টসকাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে ও শিল্পচর্চার একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেন। যা পরবরর্তী মহকুমা শিল্পকলা পরিষদের স্বীকৃতি পায়। আজ আমরা যারা শিল্পচর্চার সাথে যুক্ত, তাদের প্রত্যেকে এই মহিরুহর কাছে ঋণী।
একটি অনুন্নত পশ্চাদপদ জনপদে জন্মগ্রহণ করেও শ্রদ্ধেয় আব্দুল হাই উপলব্ধি করেছিলেন মানুষের মানসিক বিকাশে শিল্পচর্চার কোন বিকল্প নেই। আজ হয়তো এই ব্যক্তিত্ব তাঁর কাজকে ছড়িয়ে দেবার বা বিস্তৃতির অভিপ্রায়ে এমন কোন উত্তরসূরী রেখে যাননি, যাদের দ্বারা তাঁর বর্ণিল কর্মব্যস্ত জীবন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায়। তবে স্যারের মেয়ের জামাতা জনাব আল আজাদ একটি গ্রন্থ রচনা করেন স্যারকে নিয়ে, যার শিরোনাম”ভাষা সংগ্রামী আব্দুল হাই, আমি মনে করি মুহাম্মদ আব্দুল হাইয়ে’র মতো ব্যক্তিত্ব আমাদের প্রেরণা, আমাদের উৎসাহ, চলার শক্তি তাঁকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবার দায়ভার যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছেন তাদের। নয়তো এমন মহিরুহ ব্যক্তিত্ব অন্তরালেই থেকে যাবেন।
চিরদিন যদি না প্রকাশের মানসিকতা থাকে স্বজন পরিজন বন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের। আব্দুল হাই সম্পর্কে আমি ক্ষুদ্র পরিসরেই জানি। আমার প্রকাশে তাই বোঝা যায়, তবে উপলব্ধি দিয়ে এইটুকু বলতে পারি একজন ভাষাসৈনিক- বা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কেমন করে নিজেকে সুরের ভাবরসে মেলাতে পারেন!! এই ব্যাপারটা সত্যিই আমাকে ভাবাতে বাধ্য করেছে! পড়ন্ত বেলায় এসে যৌবনের চিরভালো লাগা পথ ভুলে তিনি সুরের ভাবরসে অবগাহন করলেন, মা এবং মাটির সুর, শেকড়ের সন্ধানে তিঁনি হাছন রাজার গান নিয়ে শুরু করলেন গবেষণা। এক সময় হাছনরাজার ভাব সাগরে ডুব দিয়ে হাছনের মরমী গানের ভুবনে নিজেকে হারিয়ে হাছনের গানের মাহাত্ম্য বুঝতে বুঝতে আব্দুল হাই তাঁর নামের আগে যুক্ত করে দিলেন ‘হাছন পছন্দ’ উপাধিটি, তারই ধারাবাহিকতায় এক সময় তিঁনি একটি গ্রন্থ প্রকাশনা করেন” উদাস হাছন রাজার কথা”এই শিরোনামে, তবে সন্দিহান বইটি মুদ্রনের চোখ দেখেছিলো কি না।
বিশ্বময় হাছন রাজার গানের প্রচার ও প্রসারে জনাব আব্দুল হাই স্যারের ভূমিকা মনে রাখার মতো। তার কর্মময় জীবন ও তার পরিধি এতোটা বিস্তৃত, যে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াসে তাঁর সকল কর্মকাণ্ড বর্ণনা করা অসম্ভব। কিছু মানুষ নিজের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে মানুষের মন জয় করতে পারে, ভালোবাসা নিংড়ে নিতে পারে, শ্রদ্ধেয় আব্দুল হাই তেমনই একজন। একটি পশ্চাদপদ জনপদে জন্মেও উন্নয়নের পথে তিঁনি ঠিকই হেঁটেছেন ।
চিরলোকান্তরে পাড়ি- জন্ম যেমন সত্য,তেমনি মৃত্যুও জন্মের পর অনিবার্য! নিয়মিত চলা বলা খাওয়া হাঁটা তার মাঝেও কোন একটা দিন বা সময় হয়তো নির্দিষ্ট থাকে সকলের মায়া ত্যাগ করে উর্ধলোকে পাড়ি দেবার, শ্রদ্ধেয় আব্দুল হাই ১৯৮৩ খ্রীঃ এক মধ্য দুপুরে পাড়ি জমালেন লোকান্তরে। মাত্র ৫৬ বৎসর বয়েসে প্রিয়তমা স্ত্রী ও আদরের সন্তানদের ছেড়ে । দীর্ঘ আলোকিত সময়কে উপেক্ষা করে বর্ণিল কর্মময় জীবনের সমাপ্তি টানলেন এই মহিরুহ। বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো স্যারের প্রতি।
লেখক –শিক্ষক, সংগীত শিল্পী ও সংস্কৃতিক কর্মী।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৩৯১ বার