সুনামগঞ্জ -সুনামগঞ্জে হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় বাঁধের নির্মাণ কাজের ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি’- (পিআইসি) গঠন নিয়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একই বাড়িতে ৩ পিআইসিসহ অযোগ্য, অদক্ষ, অকৃষিজীবী ব্যক্তিদের পিআইসিতে যুক্ত করা হয়েছে। হাওর থেকে দূরবর্তী গ্রামের অকৃষক থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী, ঢাকায় চাকরিরত ব্যক্তি ও কমবয়সী ছেলেদের নাম যুক্ত করা হয়েছে পিআইসিতে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সময়মতো বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু না করা।
অভিযোগ উঠেছে যোগ্য ও প্রকৃত কৃষকের নাম বাদ দিয়ে এসব নাম যুক্ত করেছে মধ্যস্বত্বভোগী ও সংশ্লিষ্ট পাউবো কর্মকর্তারা। বাঁধ নির্মাণের চেয়ে নিজের পকেট ভারি করতে উঠে পড়ে লেগে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এ নিয়ে হাওরের কৃষকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জানা যায়, বেহেলী ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামের মো. মুজিবুর রহমান একাই ৩ পিআইসি’র নিয়ন্ত্রক।
তিনি অন্তরালে থেকে এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার ছেলে মো. মোস্তাফিজুর রহমান রাসেলকে মহালিয়া হাওরের ২৪ নম্বর পিআইসি’র সভাপতি করা হয়েছে। এছাড়া হালির হাওরের ৩৭ নম্বর পিআইসি’র সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন মুজিবুর রহমানের আপন চাচাতো ভাই ও সদস্য সচিব মো. রয়েল মিয়া তার মেয়ের জামাই। একই হাওরের ৩৮ নম্বর পিআইসি’র সদস্য সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন মুজিবুর রহমানের আপন ফুফাতো ভাই। মূলত ৩৭, ৩৮ ও ২৪ নম্বর পিআইসি’র স্থানীয় প্রভাবশালী বাঁধ ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ২৬ নম্বর পিআইসি’র সদস্য সচিব করা হয়েছে মো. আজিজুল হক হীরা নামের একজনকে। তিনি সাচনা গ্রামের মো. ফজলুল হকের ছেলে। কমবয়সী এই পিআইসি’র সদস্য সচিবকে নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এছাড়া ৪৩ নং পিআইসি’র সভাপতি মো. মনোয়ার হোসেন শাহ্র বাড়ি সাচনা বাজার ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে। বাড়ি থেকে প্রায় ৮-১০ কি.মি. দূরের হালি হাওরে পিআইসি করা হয় তাকে। এছাড়া কাপড়ের দোকানের কর্মচারীও একজনকে সভাপতি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা।
সূত্রমতে, জেলার অধিকাংশ পিআইসি নিয়েই এমন বিতর্ক দেখা দিয়েছে। পিআইসিতে যুক্ত বেশির ভাগ মানুষই কাজ করার সামর্থ্য রাখেন না। তারা নামকাওয়াস্তে পিআইসি’র সভাপতি ও সদস্য সচিব হলেও তাদের নাম ব্যবহার করে মূলত কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। পিআইসিতে যাদের নাম দেয়া হয়েছে তাদেরকে দিয়ে কেবল বাঁধের কাজ করানো এবং কাগুজে স্বাক্ষর করানো হচ্ছে। প্রথম কিস্তির ওঠানো টাকাও গেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।
৩৭ নম্বর পিআইসি’র সভাপতি মোজাম্মেল হোসেনের কাছে তিনি কত নম্বর পিআইসি’র সভাপতি এবং তার কাজে কত টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি তা বলতে পারেননি। এছাড়া পিআইসি নিয়ন্ত্রক মো. মুজিবুর রহমানের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
হালি ও মহালিয়া হাওর তীরবর্তী মদনাকান্দি গ্রামের কৃষক দেবাশীষ তালুকদার জানিয়েছেন, মৃদুল, সমির, দেবব্রত, অরূপ, রামকৃষ্ণ এদেরকে পিআইসি দেয়া হয়েছে। এরা জমিজমাও করে না, এদের ১০০ টাকা বের করার মতো সামর্থ্যও নাই। আমাদের তিন-চার গ্রামের যারা আছে তারা সবাই জানে এদের অবস্থা কী। তবু তারাই পিআইসি কমিটিতে আছে। তবে এরা পিআইসি হলেও কাজ করবে অসীম চেয়ারম্যান। ওই চেয়ারম্যানই এদেরকে বিভিন্নভাবে কন্ট্রাক্ট করে পিআইসিতে যুক্ত করেছে। বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অসিম তালুকদারের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য নেয়া যায়নি।
হাওর তীরবর্তী কৃষককে বাদ দিয়ে ১০ কিলোমিটার দূরের মানুষেরা কীভাবে পিআইসি পায়, সেই প্রশ্ন রেখে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিআইসিবঞ্চিত এক কৃষক বলেন, ‘হাওরপাড়ের কৃষক হিসেবে পিআইসি’র জন্য আবেদন করেছি, পাইনি। পিআইসি পাইয়ে দিতে অনেকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, আমি টাকা খরচ করিনি।’
মামুদপুর গ্রামের কৃষক ও ইউপি সদস্য মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘যাদের কাজ করার সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই নেই তাদের পিআইসি দেয়া হয়েছে। এ ইউনিয়নে আমার ওয়ার্ডেই পিআইসি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কাজ দেয়া হয়েছে অনেক অযোগ্যদের। যাদের যোগ্যতা আছে তাদেরকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এতে কাজ সময়মতো শেষ না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।’
উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, যদি কোনো পিআইসি নিয়ে বিতর্ক কিংবা অভিযোগ উঠে তাহলে এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে আমি মনে করি। উপজেলা কাবিটা স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দেব বলেন, পিআইসি গঠনে অনিয়ম হয়েছে আমার কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ আসলে খতিয়ে দেখা হবে।