এক বছরের ব্যবধানে দেশে তালাকের হার বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার উদ্বেগজনক তথ্য এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে। মঙ্গলবার বিবিএস মিলনায়তনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে তালাকের হার বেড়ে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪টি হয়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল প্রতি হাজারে ০ দশমিক ৭টি। এর মধ্যে গ্রামে তালাকের প্রবণতা বেশি বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৫টি আর শহরে হাজারে একটি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি তালাকের আবেদন এসেছিল। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন সংখ্যা ৭ হাজার ৬৯৮টি। পক্ষান্তরে, উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫ হাজার ৫৯০টি তালাকের আবেদন পড়েছে। ফলে প্রতিদিন ঢাকায় ৩৭টি সংসার ভেঙে যাচ্ছে।
বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে প্রায় সব আবেদনেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদক সেবন করে নির্যাতন, প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, যৌন অক্ষমতা, সন্দেহ, উদাসীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাতসহ আরও কিছু অভিযোগ।
দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে পরিবার গঠন করতে হলে সামাজিকভাবে অথবা একাডেমিকভাবে যেই বিষয়গুলো একজন নারী কিংবা পুরুষের জানা উচিত, সেই শিক্ষাগুলো বা আলোচনাগুলো আমাদের দেশে নেই। একটা সুস্থ সম্পর্ক বহন করার ক্ষেত্রে এটি হলো প্রথম বাধা। তিনি বলেন, একসঙ্গে থাকতে গেলে নিজস্ব ভালো লাগা ও মন্দ লাগাকে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করে একটা একত্রিত ভালো লাগা তৈরি করতে হয়।
একটা একত্রিত সিদ্ধান্তে আসতে হয়। কখনো কখনো কোনো বিবাহিত নারী-পুরুষ এই অবস্থাতে আসতে পারে না। কখনো কখনো নারী অথবা পুরুষ মনে করে আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে। আমাদের দেশের পরিবারে সাধারণত উপার্জনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির মতামতটাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় অথবা তিনি চাপিয়ে দেন। আর যেই পরিবারগুলোতে স্বামী এবং স্ত্রী দুজনই উপার্জনের সঙ্গে জড়িত সেখানে দুজনই মতামত দিতে চায়। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে পুরুষতান্ত্রিক একটা মনোভাব বা ব্যবস্থা দ্বারা আমরা প্রভাবিত সেখানে নারীর মতামত শুনলেও কখনো কখনো সামাজিক মর্যাদার কারণে সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবগুলো বেশি মাত্রায় কাজ করে। আর তখনই তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। পদমর্যাদায় কে বড়, কে ছোট কিংবা পারিবারিক অবস্থানের দিক থেকে কে এগিয়ে বা কে পিছিয়ে এই বিষয়গুলো তখন সামনে চলে আসে।
ড. তৌহিদুল হক বলেন, চলতি সময়ে যারা বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে পরিবার গঠন করছেন তাদের মধ্যে ছাড় দেয়ার মানসিকতা এবং সামান্য ভুল-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা কম। তাদের কাছে নিজের বিষয়টি কতোটুকু গুরুত্ব পেলো বা পেলো না সেটি বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ভোগবাদের প্রভাব যখন কোনো সম্পর্কের উপরে পড়ে তখন সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এরকম বাস্তবতার সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বিষয়টি যখন নতুন মাত্রা যোগ করে তখন বিচ্ছেদের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। বর্তমান সময়ে পরস্পর সন্দেহ, কার সঙ্গে ফেসবুকিং করছে, কার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করছে এই বিষয়গুলোর কারণে বিচ্ছেদের পরিমাণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, আগেও আমাদের পরিবারের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল বা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছিল। কিন্তু দিন শেষে তারা হিসাব করতেন যে, আমি তাকে ছেড়ে যাবো না বা আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবো। দুই পরিবার মিলে ভুল বোঝাবুঝি মীমাংসা করে দিতেন। কিন্তু এখনকার বাস্তবতা ভিন্ন। এখন সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে নারী ও পুরুষ উভয়ই চিন্তা করেন যে, আমার উপার্জনে তো কোনো সমস্যা নেই। তাহলে তার সঙ্গে কেন আমাকে থাকতে হবে।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
২০৩ বার