শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে পরিচালিত একটি দুর্নীতির তদন্ত বন্ধের জন্য সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তার পদ ব্যবহার করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে জানতে তদন্ত শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটি। এ বিষয়ে কয়েকটি তথ্য জানতে চেয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের কাছে চিঠি লিখেছেন সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান চাক গ্র্যাসলে। এদিকে বাংলাদেশ সরকার মার্কিন সিনেটের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ইত্তেফাক প্রতিনিধিকে বলেন, মার্কিন সিনেটের এই উদ্যোগ প্রমাণ করে কেউ আইনের উর্ধে নয়। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে গুরুত্বপূর্ণ পদকে ব্যবহারের এই চর্চা বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, সিনেটর গ্র্যাসলে এর কমিটি এখন পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।

বয়সসীমা পার হওয়ার কারণে ২০১১ সালে ইউনূসকে যখন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও হিলারি ক্লিনটনের পারিবারিক বন্ধু। এছাড়া ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের অন্যতম একজন দাতাও।

সিনেটরের চিঠিতে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে একাধিকবার চাপ দেন, যাতে ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপ বন্ধ করার বিষয়ে তার মাকে রাজি করান। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও চাপ দেওয়া হয়।

জয় অভিযোগ করেন, তারা আমাকে সম্ভাব্য আইআরএস (ইন্টারনাল রেভিন্যু সার্ভিস) এর তদন্তের হুমকি দেয়। আমি বৈধভাবে ১৭ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি, কখনও কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ওই সময় পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা আমার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ এনে তদন্ত শুরুর হুমকি দেন। তারা আমাকে বার বার বলেছে, ‘দেখ, ইউনূসের প্রভাবশালী বন্ধু রয়েছে, আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লিনটনের বিষয়টাতো সবাই জানে। গত ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির মিউনিখে এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জয়ের ওপর চাপের বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন। তিনি বলেন, ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রাখার জন্য জয়কে চাপ দিয়েছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। হিলারি আমাকেও ফোন করে একই চাপ দিয়েছিল। এমনকি আমার ছেলেকে তিন দফা পররাষ্ট্র দপ্তর তলব করে বলেছিল আমরা সমস্যার মুখে পড়তে পারি। বিষয়টি হালকাভাবে না নিতে সতর্ক করেছিল পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা।

এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে মার্কিন সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটির চেয়ারম্যান গ্র্যাসলে গত বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে চিঠি লিখেছেন কিছু তথ্য জানার জন্য। তিনি চিঠিতে বলেছেন, হিলারির কর্মকাণ্ড সন্দেহের তৈরি করেছে যে, তিনি সম্ভবত নীতি লঙ্ঘন করেছেন এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের সততার প্রতি জনগণের আস্থার অবমূল্যায়ন করেছেন। সিনেটর গ্র্যাসলে বলেন, ই-মেইলগুলো খতিয়ে দেখা যায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা, হিলারি ক্লিনটন এবং ক্লিনটন ফাউন্ডেশন ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের পদ থেকে অপসারণের প্রক্রিয়াটি ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করেছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশে তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধে চাপ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কয়েক দফা সাক্ষাত করার চেষ্টা করেছিলেন।

তিনি চিঠিতে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতির বাইরে গিয়ে শুধু ব্যক্তিগত ও ক্লিনটন ফাউন্ডেশন থেকে উত্সারিত আর্থিক সম্পর্কের কারণে একটি সার্বভৌম সরকারের স্বাধীন তদন্তে হস্তক্ষেপে পররাষ্ট্রমন্ত্রী (হিলারি) যদি তার ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারির ক্ষমতার সঙ্গে তার পারিবারিক ফাউন্ডেশন মিলে গেলে সেটাকে সমানভাবে অসঙ্গত বলে জানিয়েছেন গ্র্যাসলে। এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রকৃতপক্ষে তদন্ত আটকাতে প্রধানমন্ত্রীর ছেলের (জয়) বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব নেওয়ার হুমকি দেওয়ার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র দপ্তরের কোনো ভূমিকা ছিল কি না, তা নির্ধারণ করা জরুরি। তিনি জানতে চেয়েছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশে ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধে আইআরএস’র কোনো তদন্তের প্রস্তাব করেছিল কিনা? এই বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিদর্শক কিংবা বিচার মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছিল কিনা, না হলে কেন করা হয়নি? একইসঙ্গে পররাষ্ট্র দপ্তরের অসম্পাদিত ইমেইল-গুলো প্রদান করতে বলা হয়েছে। আগামী ১৫ জুনের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনকে এ বিষয়ে তথ্য দিতে বলেছেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনকে পাঠানো চিঠির সঙ্গে জয়ের বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব চাওয়ার হুমকি দেওয়া বিষয়ক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনও যুক্ত করে দিয়েছেন। একইসঙ্গে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের তত্কালীন উপ মিশন প্রধান জন ড্যানিলোয়িচকে জিজ্ঞাসাবাদও করতে চেয়েছে সিনেট কমিটি। কারণ ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধের জন্য তিনি একাধিকবার সজীব ওয়াজেদ জয়কে চাপ দিয়েছিলেন এবং আইআরএস তদন্তের হুমকি দিয়েছিলেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn