আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগই
মাহমুদুল হাসান –
ঐতিহ্য, গৌরবগাঁথা ও ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৬৯ বছরে পা দিচ্ছে মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ। দলটি প্রতিষ্ঠার ৬৮ বছর পূর্তি হচ্ছে ২৩ জুন (শুক্রবার)। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী এ রাজনৈতিক দলটি। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই বললেই চলে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী যেন আওয়ামী লীগই।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদায়ী আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবার হত্যা করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ খুনিদের রক্ষার্থে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতায় বাইরে চলে যায় আওয়ামী লীগ। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সরকার গঠনের সুযোগ পায় আওয়ামী লীগ।
১৯৯৬ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল (অব.) ফারুক, শাহরিয়ার ও খায়রুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ৩১ আগস্ট ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলা দায়ের করা হয়। পরে ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। আর ওই বছর ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল পাস হয়। এই বিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে ১৯৯৭ সালের ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইনকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। এর ফলে বাঙালি জাতি একটি বর্বর অধ্যাদেশের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তৃতীয় বারের মত ক্ষমতায় আসে। দলটি ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৯ সালে সুপ্রিমকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
একই বছর নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এখন পর্যন্ত ছয় জনের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচ জন জামায়াতের এবং একজন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা। আপিল বিভাগের রায়ে আরও এক জামায়াত নেতার আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থ বারের মত ক্ষমতায় এসে এদিকে উন্নয়নের গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র ধরে রাষ্ট্রপরিচালনা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী ড. মিজানুর রহমান শেলী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন,‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার করেছে আওয়ামী লীগ। এর জন্য মানুষ আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ দিয়েছে। জাতি কলঙ্ক মুক্ত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এই মূহূর্তে দল ও রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে সব চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে আওয়ামী লীগ। এখন আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিপক্ষ নেই বললেই চলে। তাই সবাইকে নিয়েই আওয়ামী লীগকে সামনের দিকে এগুতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের আয়ের উপর যে কর আরোপ কার হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের আস্থা কমবে। এতে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। এ কারণে সময় থাকতে তাদের সাবধান হতে হবে।’ এদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করছেন আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সবসময়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আওয়ামী লীগ সব সময় সোচ্চার আছে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশে গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। দেশে এখন ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ আছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘শুধু দল নয়, একটি জাতির জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। দীর্ঘদিন পর হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্ক মুক্ত করতে পেরেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বে একটি মর্যাদার আসনে এখন বাংলাদেশ।’ আগামী দিনেও বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, ‘উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এ দলের একটি ইতিহাস, ঐতিহ্য আছে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছেন। আজকে জনগণের ঐক্যবদ্ধ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার পর পর দুই দেশ পরিচালনা করছেন।’ তিনি বলেন, ‘দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। আগামীতে ২০১৯ সালের নির্বাচনেও জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিবে।’ এদিকে সংগ্রাম ও সাফল্যের ৬৮ বছর পূর্তি পালনে নানা কর্মসূচি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। শুক্রবার সূর্যোদয়ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল নয়টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হবে।। এছাড়া সকাল সাড়ে নয়টায় টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধি দল শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবেন।