ওয়েছ খছরু :
সিলেটের বারুতখানার বাসিন্দা দুলালের সঙ্গে নিহত রোকেয়া বেগমের বিয়ে বৈধ ছিল না। রক্ষিতা হিসেবেই দুলাল রোকেয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিলেন । সেই সম্পর্কেও ফাটল ধরে। এরপর থেকে রোকেয়া রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী শহরতলীর মুক্তির চকের নাজমুলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েন। প্রায় ১০ মাস রোকেয়া ও নাজমুল মিরাবাজারের খারপাড়া ওই বাসায় বসবাস করছেন। নাজমুল প্রায় প্রতিদিন আসতেন রোকেয়ার বাসায়।রোকেয়াও নাজমুলকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসা থেকে তারা স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করেছেন। সে টি জানতেন রোকেয়ার স্বজনরাও। তবে- নাজমুল নিহত রোকেয়াকে রক্ষিতা হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। সম্প্রতি সময়ে লন্ডনি মেয়ের সঙ্গে নাজমুলের বিয়ের কথা-বার্তা চলছিল। বিয়েও প্রায় ঠিকঠাক। এই সময়ে বাধা হয়ে দাঁড়ান প্রেমিকা রোকেয়া। কোনোভাবে তিনি নাজমুলের সঙ্গ ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। সেই আক্রোশ থেকে খুন করা হয়েছে রোকেয়া বেগমকে। সঙ্গে তার এসএসসি পরীক্ষা দেয়া ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমকে।

সিলেটের কোতোয়ালি থানায় গতকাল সাংবাদিকদের সামনে গ্রেপ্তার হওয়া নাজমুলকে হাজির করে পুলিশ তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে- রোকেয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল হাই প্রোপাইল আরো কয়েকজন ব্যক্তির। যারা সব সময় রোকেয়ার বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। পুলিশ তাদের দিকেও নজর রাখছে। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে এসব কিছু পেলেও গ্রেপ্তার হওয়া নাজমুল খুনের ঘটনা সম্পর্কে এখনো মুখ খুলেনি। সাংবাদিকদের সামনেও বলেছে- ‘আমি ঘটনার কিছুই জানি না।’ তবে রোকেয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কে কথা স্বীকার করেছে। রোববার দুপুরে সিলেট নগরীর মিরাবাজারের খারপাড়ার ১৫-জে, বাসার নিচতলার ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ রোকেয়া বেগম ও তার ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমের লাশ উদ্ধার করে। ঘটনার সময় বেঁচে যাওয়া রোকেয়া বেগমের ৫ বছরের সন্তান রাইসাকেও পুলিশ আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। খুনের ঘটনা সম্পর্কে রাইসা পুলিশকে জানিয়েছে তার মা রোকেয়া বেগমকে খুন করেছে নাজমুল ও ভাইকে খুন করেছে তানিয়া। এরপর থেকে পুলিশ ওই দুইজনকে খুঁজছিলো। এর মধ্যে পুলিশ প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান শুরু করে।

প্রযুক্তির অনুসন্ধানে দেখা গেছে- রোকেয়া বেগমের মোবাইল ফোনে নাজমুলের যোগাযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া, নাজমুলের মোবাইল ফোনেরও প্রায় সময় অবস্থান ছিল নাজমুলের বাসায়। খুনের ঘটনার সময় নাজমুলের অবস্থান ছিল ওই বাসায়। ফলে পুলিশ নাজমুলকে খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু লাশ উদ্ধারের দিন দুপুর থেকে হঠাৎ করে নাজমুলের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর থেকে সে সব যোগাযোগ বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যায়। নাজমুলের বাড়ি সিলেটের শাহ্‌পরান থানার নিকটবর্তী গ্রাম মুক্তিরচকে। তার পিতা করিম মেম্বার। পুলিশ টানা দুইদিন অভিযান চালিয়ে সিলেট শহরতলীর বটেশ্বর এলাকা থেকে মঙ্গলবার গভীর রাতে নাজমুলকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ সিলেটের কোতোয়ালি থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকা রাইসাকে নাজমুলের ছবি দেখালে রাইসা নাজমুলকে শনাক্ত করে। তবে- মুখ খোলেনি নাজমুল। কোতোয়ালি থানার এসি সাদেক কাওছার দস্তগীর থানায় প্রেস ব্রিফিংকালে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- ‘মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা নাজমুলকে শনাক্ত করি। পাশাপাশি রাইসার মুখ থেকেও ওই নামটি আমরা পেয়েছি।

খুনের ঘটনার পরও সে সিলেট শহরেই ছিল। আর লাশ উদ্ধারের পর থেকে সে আত্মগোপনে চলে যায়। এ কারণে নাজমুলের প্রতি সন্দেহ ছিল বেশি। তবে- নাজমুল এখনো খুনের ঘটনা স্বীকার করেনি। তবে- রোকেয়া বেগমের সঙ্গে তার গভীর প্রেম ও দৈহিক সম্পর্কের কথা কিছুটা স্বীকার করেছে।’ বিকেলে সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি গৌসুল হোসেন  জানিয়েছেন- তারা বিকেলে সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরোর আদালতে হাজির করে নাজমুলের ৭ দিনের রিমান্ড চান। আদালত তার ৭ দিনেরই রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এখন তাকে কোতোয়ালি থানাতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেটের কোতোয়ালি থানার এসআই রোকেয়া খানম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- বেঁচে যাওয়া রাইসা তার মা ও ভাইকে খুঁজে ফিরছে। তাকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। তার এক আত্মীয় সঙ্গে রয়েছেন। রাইসা এখনো অসুস্থ। তার চিকিৎসা চলছে বলে জানান তিনি। তিনি জানান- পুরুষ দেখলেই ভয় পায় রাইসা। একা সে দরোজার সামনে পর্যন্ত যায় না। রোকেয়া ও তার ছেলে রূপম হত্যার পর পুলিশ নিহত রোকেয়া সম্পর্কে অনেক তথ্যই পেয়েছে। রোকেয়া বেগম সিলেট শহরতলীর দক্ষিণ সুরমার নৈখাই এলাকায় ভাইদের সঙ্গে জমি কিনেছেন। সেখানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করে তিনি বাসা তৈরীর করছেন।

এছাড়া সিলেট নগরীর মিরাবাজারে যে বাসায় বসবাস করতেন সে বাসার ভাড়া ছিল ১৫ হাজার টাকা। সেই বাসা আধুনিক ফার্নিচারে সুসজ্জিত ছিল। পুলিশ রোকেয়া বেগমের কললিস্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে তার সঙ্গে সিলেট নগরীর বহু মানুষের যোগাযোগ ছিল। সিলেটের হাই-প্রোপাইল কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। ঘটনার এক-দুইদিন আগেও ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। এমনকি রোকেয়া বেগমের বাসাতেও ওই ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল। এরই মধ্যে পুলিশ দুইজনকে শনাক্ত করেছে। তাদের বিষয়েও তদন্ত চলছে। কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানিয়েছে- রোকেয়া বেগমের বাসায় ঘটনার দিন বেশকিছু আলামত উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ছিল বেনসন সিগারেটের প্যাকেট, ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদি, কয়েকটি কনডমের প্যাকেট। পুলিশ জানায়- রোকেয়া বেগমের বাসা ছিল ওয়ানস্টপ সেক্সুয়াল সার্ভিসের ঠিকানা। তার ওখানে অনেকেই যেতো। এবং তারা নিরাপদে সেক্স করার সুযোগ পেতো। পাশাপাশি মাদকও পাওয়া যেতো। আর এটিই ছিল রোকেয়ার আয়ের অন্যতম উৎস। তানিয়া নামের ওই যুবতী রোকেয়ার বাসার কাজের মেয়ে ছিল না। তানিয়াও ছিল সেক্সকর্মী। সে পুরুষদের নিয়ে ওই বাসাতে যেতো। এবং সেখানে পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হতো। তানিয়া নামে ওই মহিলার আসল নাম তানিয়া কী না সেটি নিয়ে পুলিশ সন্ধিহান। তানিয়া ওই মহিলার ছদ্মনাম হতে পারে।

তানিয়া গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি বলে জানান ওসি কোতোয়ালি। তানিয়ার সঙ্গে কয়েক দিন আগে বিরোধ লেগেছিল নিহত রোকেয়ার। সেটি ভাগ-বাটেয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে তানিয়াই বাসায় নিয়ে এসেছিলো এলাকার যুবক কাঞ্চা সুমনসহ কয়েকজনকে। এরপর থেকে কাঞ্চা সুমন ও তার বন্ধুরা প্রায় সময় গিয়ে আমোদ-ফুর্তি করতো। খুনের ঘটনার আগেও তানিয়া নামের ওই মহিলা নিহত রোকেয়ার বাসাতে গিয়েছিলো।

পুলিশ জানায়- নিহত রোকেয়ার বাসা থেকে যে কম্পিউটার ও ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো প্রায় ৪০ জন নারীর ছবি পাওয়া গেছে। এসব ছবির মধ্যে কোনো কোনো নারীর ছবি অর্ধনগ্ন আবার কোনো কোনোটি ছিল পুরো নগ্ন। এসব দেখে পুলিশ ধারণা করে- যেসব নারীর ছবি তার ল্যাপটপে পাওয়া গেছে তারা তানিয়ার বাসায় যেতো। এবং সেখানে তারা খদ্দেরদের সঙ্গে মনোরঞ্জন করতো। এসব নারীদের সন্ধানও পুলিশ করছে। এলাকা সূত্র জানিয়েছে- এলাকার অনেকেই নিহত রোকেয়ার পরিবার নিয়ে সন্দেহে ছিলেন। তার বাসায় মানুষের অবাধ যাতায়াত এলাকার মানুষকে বিব্রত করতো। আর রোকেয়ার বেপরোয়া আচরণের বিষয়টি এলাকার যুবকদের কাছে ধরা পড়ে যায়। এ কারণে রোকেয়া নিজেই ওই এলাকায় বসবাস করা দায় হয়ে পড়েছিল।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn