‘আমরা’ বিভক্ত বহুধা-শতধায়
সঙ্গীতা ইয়াসমিন– সপ্তাহখানেক আগে আমার কন্যার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তার স্কুলের কোনো এক মেয়ে বলেছে, ‘‘আই উইল বিট ইউ’’। কন্যা যথারীতি ঘাবড়ে গেছে, ভয়ই পেয়েছে কেবল তাইই নয়, সে অসম্মানিত হয়েছে। সে ভয়াবহ রকমের আপসেট হয়েছে। মন খারাপ করে কাঁদো কাঁদো গলায় এসে আমাকে জানিয়েছে। মা হিসেবে, প্রথমত আমি খুবই আন্তরিকতার সাথে তার অভিযোগ শুনেছি, এবং বোঝার চেষ্টা করেছি সম্ভাব্য কী কী কারণ থাকতে পারে এ জাতীয় কথোপকথনের পেছনে। কন্যার সাথে প্রশ্নোত্তর শেষে আমি দুশ্চিন্তা করার মতো বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সে তার চেয়ে দুই বছরের সিনিয়র এক মেয়ে, যে কিনা অলরেডি স্কুল ছেড়ে চলে গিয়েছে। সুতরাং আমার কন্যার সংস্পর্শে তার আসার সুযোগ খুবই ক্ষীণ। কন্যাকে সবরকম সান্ত্বনা দিয়ে কাউন্সেলিং করে তার পাশে থাকবার চেষ্টা করেছি। অভয় দিয়েছি, তোমার কোনো ভয় নেই, মা আছে পাশে, তুমি নিরাপদ।
সপ্তাহখানেক পরে, আমি তখন স্কুলে, হঠাৎ কন্যার স্কুলের প্রিন্সিপ্যালের ফোন। সাধারণত কাজের সময়ে আমাদের ফোন রিসিভ করাও নিষেধ, কিন্তু কন্যার স্কুলের ফোন মানেই এটা এমারজেন্সি ফোন। তাই আমাকে ধরতেই হল কল। প্রিন্সিপ্যাল আমাকে এই ঘটনার বিষয়ে আমি আদতেই কিছু জানি কিনা জানতে চাইলেন। আমার জবাব শুনে তিনি বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সাথে নিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করলেন এবং বললেন, আমার কন্যা এবং আমি চাইলে তাঁরা পুলিশ কল করবেন। তবে, আপাতত কোনো সমস্যা, ভয় নেই, কারণ, সেই মেয়েটি আর স্কুলে আসছে না। তাঁরা স্কুলের সকল শিক্ষকসহ সাপোর্ট স্টাফদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, যদি কেউ কখনও স্কুলের ত্রিসীমানায় মেয়েটিকে দেখে, তবে সাথে সাথে ৯১১-(এমারজেন্সি পুলিশ) কল করে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করবেন, একথাও আমাকে জোর দিয়ে বললেন। কারণ, এই অভিযোগটি আমার কন্যা তার প্রিন্সিপ্যালকে করেছিল যা সে আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ যেটা করেছেন এটাই প্রত্যাশিত। কেননা, এই সমাজে মানুষ হল সবচেয়ে মর্যাদার অধিকারী! আর শিশু হল সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষিত হবে সমাজের সকল প্রতিষ্ঠান সেই কাজ করতে আইনত বাধ্য। না করলে কিংবা করতে ব্যর্থ হলে আইনের সাহায্য নেয়ার সবরকম অধিকার ভিকটিমের আছে।
বাংলাদেশে বেড়ে ওঠার কারণে, একটি সতেরো বছরের মেয়েকে আরেকটি উনিশ বছরের মেয়ের মাইর দিতে চাওয়াকে আমার কাছে হুমকি, কিংবা কোনোরূপ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মনে হয়নি। ভয়ও পাইনি আমি একথা সত্যি। ভেবেছিলাম, পূর্ব কোনো রাগ, বিরাগভাজনের ঘটনা থাকলেও থাকতে পারে দুজনের মধ্যে। কিংবা আদতেই শিশুমন, এমনিই হয়তো ভয় পাইয়ে দিতে, মজা পেতে এমন কথা বলেছে। কিন্তু এই সমাজ এভাবেই তৈরি; সে তুমি যে-ই হও, কাউকে অসম্মান করে, হেইট করে, জাত-ধর্ম-বর্ণ তুলে কোনোরূপ ইঙ্গিত করেও কথা বলতে পারো না। সেটা হিউম্যান রাইটসের পরিপন্থী! আর সেই মানবাধিকারবিরোধী কাজের জন্য আইনের কাছে তোমায় জবাবদিহি করতেই হবে। কাউকে কোনোরূপ থ্রেট দেওয়া মানেই সেটি অপরাধ! আমার কন্যা যেমন সেটি জানে, আর তাই সে অনেক বেশি অপমানবোধ করেছে, আবার স্কুলও আইন এবং তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল বিধায় তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমাজ কি একদিনেই এই জায়গায় পৌঁছেছে? আইনের ভূমিকা সমাজ বিনির্মাণে কতটুকু? আইন শুধু প্রণয়নই কি শেষ কথা? নাকি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে আইনি তৎপরতা সরাসরি সম্পৃক্ত? যেখানে আইনের চোখ ক্ষমতার লেন্স দিয়ে দেখে, আইনের শাসনহীন সমাজে নানাবিধ অপরাধ ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে গিয়ে সমাজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে, সেই সমাজ বিনির্মাণের কাজে আইন কি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো কোনো বংশীবাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে? কিংবা মৃত্যুদণ্ড অমানবিক বিধায় অপরাধীকে মানবতার দোহাই দিয়ে, শোধরানোর নামে ছেড়ে দিয়ে আরও উন্নত জাতের উচ্চফলনশীল অপরাধের চারণভূমিতে পরিণত করা হবে দেশটাকে? যদিও এসব প্রশ্নের সদুত্তর কারোই জানা নেই।
হ্যাঁ, বলছিলাম, বর্তমানে বহুল আলোচিত ধর্ষণের সংশোধিত আইনে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিয়ে। যে সমাজে আইনের শাসন নেই, সেখানে আইন পরিবর্তন করে আপাত আন্দোলন বন্ধ করা যায়। দমিয়ে রাখা যায় ফুঁসে ওঠা জনরোষ! তবে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সরকারের সদিচ্ছা নেই, ধর্ষণের বিচার করার। যারা এ জাতীয় জঘন্য কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত তারা প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতা কাঠামোর খুব কাছেই অবস্থান করে, অতীতের এমন অনেক ঘটনা ঘাঁটলেই আমরা খুব সহজেই তার প্রমাণ পাই। অপরাধী কখনও অপরাধী হয়ে জন্মায় না এ কথা যেমন সত্য, তেমনি অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সুস্থ, পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ, সুশিক্ষা, সমাজ-মনস্তত্ত্বের গবেষণাসহ সামাজিক মূল্যবোধের চর্চাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুশকিল হল, সুস্থ সমাজে বসবাস করলেই না এসকল সামাজিক অনুষঙ্গের মধ্যে মানুষের একটা সহ সম্পর্ক তৈরি হয়, এবং তা থেকে জনসাধারণেরা ফল লাভ করতে পারে। যে সমাজ বহুধা বিভক্ত তাঁদের জাতিগত প্রশ্নে। যে সমাজ না ইসলামিক না অসাম্প্রদায়িক, যে সমাজ স্বাধীনতা বিরোধী নাকি স্বাধীনতার পক্ষের, যে সমাজ বাঙালি নাকি বাংলাদেশী জাতীয়তায় বিশ্বাসী এই দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ভুগছে জন্মেরও অর্ধশত বছর পেরিয়ে। তাঁদের কাছে চোর-চোট্টামি, গুণ্ডামি-ভণ্ডামি, খুন-ছিনতাই-রাহাজানি, ধর্ষণ-ডাকাতি ছাড়া সমাজ বিনির্মাণ আশা করা কি বাতুলতা নয়?
গত তিন দশকে বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে ‘জনসাধারণ’ শব্দটি মুছে ফেলা হয়ে সুচতুরতার সাথে।এখানে আমাদের রাজনীতিকেরা সর্বোচ্চ সফল। এখন আমরা আওয়ামী ঘরানা, বাম-ডান ঘরানা, জামায়াতি-বামাতি কিংবা বিএনপির দলীয় কোনো হোমরা-চোমরা, কেউকেটা, উচ্চপদস্থ পা চাটা লেজ নাড়ানো কুকুর! সাংস্কৃতিক দলের মধ্যেও আছে বিভাজন, আছে বিভাজন পেশাগত সংগঠনগুলিতেও, আছে সিভিল সোসাইটিতেও। কেউই নিজের দলীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে একটি হক কথাও বলেন না। সকলেই চান দলকে খুশি করতে। আখেরে দল খুশি তো আপকা দিল খুশ, আর দিল খুশতো জান খুশ! সুতরাং সমাজ বিনির্মাণের দায় কি রাষ্ট্র নামক এক ইট-কাঠ-বালি-পাথরের চৌহদ্দির?
আমরা যেদিন শুধু ‘আমরা’ ছিলাম, ছিলাম জনগণ, সেদিন আমাদেরকে সরকার ভয় পেত। আমরা একদিন ব্রিটিশ তাড়িয়েছিলাম, একদিন ভাষার জন্য লড়ে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম মায়ের মুখের ভাষাকে। একদিন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শক্তিশালী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জিতে নিজের জন্য একটি পতাকা বানিয়েছিলাম। হ্যাঁ, এই আমরাই, সেই আমরা জনগণ! আমরা সাধারণ জনগণ। আমাদের একাত্মতা, আমাদের বোধ, আমাদের চেতনার গণজাগরণের ফলেই সেসব সম্ভব হয়েছিল। সেসব রাষ্ট্র করেনি, সেসব সংবিধান কিংবা আইনের বলে অর্জিত হয়নি। হয়েছিল সময় আর প্রয়োজনের তাগিদে।
আজও যদি আপনি আমি এক হই, ‘আমরা’ হয়ে উঠি, তবে এই সমাজ বিনির্মাণের কাজ এগুবে। সমাজ থেকে ধর্ষণসহ অন্যান্য সকল অনাচার দূরীভূত হবে, দূর হবে অন্ধকার। আমাদের চারপাশটা ঝাঁটপাট দিয়ে পরিস্কার আমাদেরই রাখতে হবে তো! আর সেক্ষেত্রে, একটু গোয়াল ছেড়ে বাইরে এসেই হাঁকটা দিতে হবে আর কি! মানে ঘরানা থেকে বের হতে হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে এসে জগতটাকে দেখতে হবে। কেবল ফেবুতে এসে পাণ্ডিত্য জাহির না করে, ইনিয়ে বিনিয়ে কথা না বলে, মেরুদণ্ড সোজা করে স্বর উঁচিয়ে কথা বলুন। দেখবেন জনতার সমস্বর কোনো শাসকের চেয়েই কস্মিনকালেও ছোট নয়! শুধু অন্যে করবে, কিংবা অন্যের কী করাটা উচিত হয়নি সেই বিশ্লেষণ না করে আমিও কিছু দায় নিই, আমিও হয়ে উঠি সমাজ বিনির্মাণের কারিগর।
আজ এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের সম্মুখে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ; মানবজাতির অস্তিত্বের লড়াই! কারণ, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বাজারে এসে গেছে এ (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স), ফলত সকল সেক্টরেই মানব সম্পদ হ্রাস হওয়ার একটা ভয়াবহ শঙ্কা রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদ, সমাজ গবেষকসহ ব্যবসায়ী ও প্রযুক্তিবিদদের মত। বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছোট্ট একটি দেশও বিশ্ববাজারের এ সঙ্কটের অংশ হবেই সে কথা জোর দিয়ে বলা যায়। সুতরাং আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে ঘর থেকে বেরিয়ে আরও বহু দূরে। আর সেই দৃষ্টি দিয়ে আগে মানবতার লড়াইটা লড়ি। তাই, আসুন সবরকম বিভাজন ভুলে মানবতার বিরুদ্ধে একাত্ম হই, প্রতিবাদ করি, বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি। জনতার জয় হবেই।-সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব।সুনামগঞ্জ বার্তা ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে সুনামগঞ্জ বার্তা ডটকম আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।