আমার অস্বস্তির অন্যতম কারণ সবুজ পাসপোর্ট
তাহমিমা আনাম : আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি একটি পাসপোর্ট নিয়ে হয়রানিতে ভুগেছি। এটি সবুজ রঙ্গের যার ওপর লেখা আছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’। বিমানবন্দরে আমার অস্বস্তির অন্যতম কারণ ছিল এই সবুজ পাসপোর্ট। এই পাসপোর্ট হাতে রাখা অবস্থায় আমাকে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ভ্রুকুটি এবং তদন্তের সম্মুখীন হতে হত। আমি কত দিন থাকব, আমার সঙ্গে কি পরিমাণ টাকা আছে এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি অনেকবার।
লাইনে আমি একমাত্র ব্যক্তি ছিলাম যাকে অধিক সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হত এবং আমার পেছনের মানুষরা অধৈর্য হয়ে ঘোরাফেরা করতেন। আমি যে দেশেই যেতাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র, ব্যাংকের তথ্য, কলেজের অনুলিপি পর্যন্ত নিয়ে যেতাম। একবার আমার বার্সেলোনায় পারিবারিক সফরে যাওয়ার কথা ছিল। ভিসার জন্য রাতে আমি ঢাকার স্পেন দূতাবাসে যাই। আমি দূতাবাস থেকে বের হই সকালের সূর্য দেখে। আমার সঙ্গে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্ডান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকরা। এরা সবাই আমার মত পাসপোর্ট জটিলতায় পড়েছিলেন।
যদিও আমার এই পাসপোর্টের মূল্য অসীম। কারণ এটি অনেক কষ্টে অর্জিত হয়েছিল। আমার দাদা ভারতীয় উপমহাদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমার বাবা-মা জন্মেছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীনতা পায়নি এবং আমার শৈশবের আগেই সেই কঠিন দিনগুলো আমার দেশ পার করেছে। নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে, আমারা পাকিস্তানের আওতাভুক্ত থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ছিলাম আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে কতটা সৌভাগ্যবান। জন্মসূত্রে এই দেশে জন্মগ্রহণ করে আমি আমার অধিকার কতটা পেয়েছি।
ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে মন্ত্রীসভা ২০১৬ সালের নাগরিক আইনের খসড়া প্রণয়ন করে। এতে দ্বি-নাগরিকত্বের প্রস্তাবনা দেয়া হয়। বেশিরভাগ দেশই এখন স্থায়ী নাগরিক এবং দ্বি-নাগরিকত্ব অনুমোদন দিচ্ছে। বাংলাদেশে আগে দ্বি-নাগরিকত্বের বিষয়ে কোনো বিধি-নিষেধ ছিল না। নতুন আইনে এটি পাল্টে গেল। দ্বি-নাগরিকত্বধারীরা কোনো রাজনীতিক সংগঠন এবং সরকারি কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। সবচাইতে খারাপ দিকটি হলো তাদের সন্তানদের জন্যও বিভিন্ন বিধি-নিষেধ জারি করা হয়েছে। যদি এগুলো পালন না করা হয় তাহলে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে।
এই আইনের সবচাইতে অশুভ দিকটি হল রাষ্ট্র চাইলে কিছু নির্দিষ্ট কারণে নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারবে। যেমন, যদি বাংলাদেশে সঙ্গে কোন দেশের যুদ্ধ লাগে এবং বাংলাদেশি দ্বি-নাগরিকত্বধারী কোন নাগরিক যদি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা সংবিধানকে অমান্য করেন অথবা তার বাবা-মা যদি শত্রুদের মিত্র হয়ে থাকেন তাহলে তার নাগরিকত্ব রাষ্ট্র বাতিল করতে পারবে।
এই দুইটি শর্তই অশুভ এবং অস্পষ্ট। এই আইনে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা সংবিধানকে অমান্য বলতে কি বোঝানো হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর হল, সরকার এই সমস্ত বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে একশ্রেণির কর্মকর্তাদের প্রস্তাব দিবেন (আমরা জানি না তারা কারা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা না কি সেনাবাহিনীর লোক অথবা সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত কি না)। তবে এরা যে সিদ্ধান্ত নিবেন সেটিই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। কোনো আদালত তাদের সিদ্ধান্তের বাহিরে যেতে পারবে না। এর মাধ্যমেই বোঝা যায়, প্রস্তাবিত এই আইনে কি ঘটতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র তার পছন্দমত নাগরিক বাছাই করতে পারবে এবং রাষ্ট্রের বিবেচনা মোতাবেক ও শর্তানুযায়ী নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
পরিশেষে এটিই দাঁড়ায় যে, এই আইন দ্বৈত নাগরিকত্বের আইন নয়। এটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা একীভূতকরণ ও কি কি বিষয় থাকলে যোগ্য নাগরিক হওয়া সম্ভব এবং নাগরিকত্ব বাতিলের আইন। এটি একটি নির্মম পরিহাস। যারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নাগরিক এবং ভবিষ্যতে যারা নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবেন বাংলাদেশ তাদের অধিকার সীমিত করতে চাইছে। কিন্তু এটি মৌলিকতার ওপর মিথ্যারোপ। আমাদের মত লক্ষ লক্ষ মানুষ অর্থনীতিক, সামাজিক এবং রাজনীতিক কারণে জন্মস্থান ছেড়ে আসেন। আমরা অন্য দেশের দরজায় কড়া নাড়ি। আমাদের ভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক হয় এবং আমরা সন্তান ধারণ করি। আমরা শান্তিরক্ষী, নির্মাতা, গৃহকর্মী এবং ড্রাইভার হিসেবে কাজ করি। আমরা শরণার্থী এবং অভিবাসী।
এটি আমার মত ১৫ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসীর জন্য চিন্তার বিষয়। কারণ বাংলাদেশে তারা রেমিটেন্স পাঠায় এবং ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে এর পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ৮ শতাংশ। তারা সরকারের কাছ থেকে জন্মগত অধিকার ছাড়া আর কোনো কিছুই আশা করে না।
বাংলাদেশ সরকারের এর নাগরিকত্বের সুযোগ সহজ করা উচিত। দ্বি-নাগরিকত্ব ও ভিন্ন ধরনের নাগরিকত্বের মত শাস্তি না দিয়ে অভিবাসনের শক্তিকে কাজে লাগানো উচিত। ইতিহাসবিদ এবং লেখক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন যাকে ‘গভীর আনুভূমিক সঙ্গী’র কথা বলেছেন যা নাগরিকত্ব থেকে আসে।
আমি বিদেশে বসবাস করা কোনো বাংলাদেশি অভিবাসীর আশা আকাঙ্খার কথা জানি না। জানি না তারা তাদের ঘর-বাড়ি নিয়ে কি আশা করে। ২০১০ সালে আমি একজন আমেরিকানকে বিয়ে করি। এক বছর পর আমি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাই। আমাদের বিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠান লন্ডনের ক্যামডান টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমাদের সন্তান ইস্ট লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। যার জন্য তাদের কখোনোই ভিসা পাওয়ার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে না এবং ইমিগ্রেশন দপ্তরে তারা কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করবে না। তাদের দুইটি পরিচয় আছে, যেখানে তার জন্মেছে এবং তার মা যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছে। আমার প্রত্যাশা বাংলাদেশ সরকার এটি কখোনোই অবহেলা করবে না।
লেখক: লেখক ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামের কন্যা।