আমি আজ শুধু একটি দাবি নিয়ে এসেছি…
ঘটনা শোনার পরপরই ওয়ারী বিভাগের ডিসি স্যারসহ সকল ঊর্ধ্বতন অফিসার ঘটনাস্থলে হাজির হন। তাৎক্ষণিক থানা ও গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকটি টিম কাজ করা শুরু করে আসামীদের আইনের আওতায় আনতে। গতকাল ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আসামীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হই আমরা। আমি বা আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। এই সাফল্য সুক্ষ্ম তীরের ফলার মত আঘাত করেই যাচ্ছে আমাদের। বাচ্চা দুটোর চেহারা থেকে থেকে চোখে ভাসছে। দুইরাত ঘুমুতে পারিনি। বারবার চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। ওদের পরিবারকে কী সান্ত্বনা দেবো, নিজেকেই তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না! আহা! ছোট্ট মায়েরা আমার। মা বাবার আদরের ধন সোনা পাখি দোলা, নুসরাত কেমন আছো মায়েরা আমার। ওপারে সৃষ্টিকর্তার কাছে পরম যতনে আছো তাইনা মা? নিজে সন্তানের পিতা হলে আরেক পিতার কষ্ট উপলব্ধি করা যায়। আমি এই সমাজকে ধিক্কার দেই, যে সমাজে মোস্তফা, আজিজুলের মত বিকৃত রুচির মানুষ বসবাস করে। দুঃখ এখানেই যে এই কাপুরুষদেরও নিজ কন্যা সন্তান রয়েছে। তারপরও আরেকজনের সন্তানকে গলা টিপে মারতে ওদের হাত কেঁপে উঠেনি। এ কেমন জনম? এ কেমন বেঁচে থাকা ওদের?
আসামীদের গ্রেফতার করা হয়েছে টানা অভিযান চালিয়ে ; আমি আজ সেই গল্প বলতে আসিনি, আমি আজ দাবী নিয়ে এসেছি। যে দুই কুলাঙ্গার ফুলের মত বাচ্চা দুটোকে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে না পেরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। আমরা তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য কাজ করছি। আমার দাবী আইনজীবী ভাই বোনদের প্রতি; আপনারা যারা ওকালতির মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেন। দয়া করে ফুলের মত বাচ্চা দুটোর হন্তারকের পক্ষে কেউ আইনী লড়াইয়ে নামবেন না। একটি বার দোলা আর নুসরাতকে আপনার নিজের সন্তান ভাবুন। ওদের বাবা মায়ের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করান! আপনারাও তো চান অপরাধীর শাস্তি হোক, তাই ওদের পক্ষে পেশাগত জায়গা থেকে কেউ লড়বেন না প্লিজ। আপনার পেশাগত দিক আপনাকে যে কারো পক্ষে লড়ার কথা মনে করিয়ে দিতেই পারে। কিন্তু যে অপরাধীর স্ত্রী নিজে তার স্বামীর শাস্তি প্রত্যাশা করেন, তার জন্য আপনার তো কোনো দায় থাকার কথা নাহ্! একটিবার একটি বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করুন না! আপনাদের শিশু সন্তানেরা যেন আপনাদের নিয়ে গর্ব করতে পারে সেরকম একটি উদাহরণ সৃষ্টি করুন প্লিজ। একটিবার আমাদের বাচ্চাদের বুঝতে দিন ওরা কমপক্ষে আমাদের কাছে নিরাপদ। আমার এই দাবিটি রাখুন প্লিজ। এটি আমার অন্তরের চাওয়া…
আইনী প্রক্রিয়ায় পুলিশের জায়গা থেকে সর্বাত্মক পেশাদারিত্ব দেখিয়ে আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা তৎপর আছি ও থাকবো। এই ঘটনা আমি একজন অফিসার নয়, একজন পিতা হিসেবে দেখছি। পিতার বুকের বেদনা আমার চোখজোড়াকেও বারবার ভিজিয়ে যাচ্ছে! আমি এই শোক থেকে কোনো শক্তি নিতে চাচ্ছি না। শোকে পাথর বাবা মায়ের জন্য আমার কোনো শান্তনার বাণীও নেই। আমি পিতার বুকেও একরাশ হাহাকার বয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। এসব জাতির কলঙ্কের শাস্তির মাত্রা কেমনতর হওয়া উচিত সেটি ভাববার সময়টি বুঝি এসেছে এবার। বিকৃত মানসিকতার এসব মানুষ আপনার আমার আশেপাশেই ঘুরে ফিরছে। নিজ সন্তানকে চোখে চোখে রাখুন। কাছের দূরের আত্মীয় স্বজনের বাড়তি আদর থেকেও নিজ সন্তানকে রক্ষা করুন। প্রায়শই প্রতিবেশীদের দ্বারা এরকম কুকর্ম সংঘটিত হচ্ছে, তাদের কাছ থেকেও নিজ সন্তানকে দেখে রাখতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক কাছের আপনজন ছাড়া নিজ শিশুকে একা কোথাও ছাড়বেন না প্লিজ। সামাজিক এই অবক্ষয় রোধে আমাদের সচেতনতাই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
আজ দোলার ৫ম জন্মদিবস উদযাপিত হতো যদি ওহ বেঁচে থাকতো। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বিকৃত মানসিকতার পশুদের জন্য আমাদের সন্তানেরা অনিরাপদ রয়েছে। সারা বিশ্বব্যাপী এর আগ্রাসন বিস্তার করেছে। এর সমাধান কঠিন আইন প্রয়োগ আর সচেতনতায়! আইনের যথাযথ প্রয়োগে তৎপর আছি আমরা, আপনারা সচেতনতায় তৎপর হোন দয়া করে! এটি আমার বিনীত প্রার্থনা! দোলা আজ তুই ৫ বছরে পা দিলি মা! তুই তোর বান্ধবী নুসরাতকে নিয়ে বেহেশতের বাগানে ঘুরছিস আমি জানি মা! তোরা দু’জন তো একটা চকোলেটও ভাগ করে খেতি মা! ওখানে সৃষ্টিকর্তা তোদের পরম যতনে রেখেছে তাও আমি জানি! হ্যা ওই কুলাঙ্গার আসামী দুটো ধরা পড়েছে মা; আমি জানি তোদের কিছু আসছে, যাচ্ছে না। পার্থিব জীবনের মায়ার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছিস তোরা তাই না মা! আমি পুলিশ কাক্কু চোখ মুছছি আর লিখছি মা; আমাদের ক্ষমা করিস মা। দুনিয়াতে ওই কুলাঙ্গারদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা নিশ্চিত করবো মা! মাফ করে দিস লক্ষ্মী মা আমার। ওপর থেকে খুব হাসছিস তাই না মা? এই সমাজের অপারগতায় খুব হেসে যাচ্ছিস তাই নারে মা! কলিজা মানিক আমার মহান আল্লাহ তোদের অনেক ভাল রাখুন। এখন থেকে অবিরত আমার মেয়ের পাশাপাশি তোরাও আমার প্রার্থনায় আছিস এবং থাকবি মা।
(পেশাগত এই সাফল্যের চেয়ে আমার সন্তানের বেঁচে থাকা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ! আমি হাজারো দিন পেশাগত সাফল্য না পেয়ে শুধু আমাদের সন্তানদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা দেখতে চাই; বিনাশ চাই মানসিক বিকৃতমনা অমানুষদের!)
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন)