গত সপ্তাহে আমি কয়েকদিন কোনো পত্রিকা পড়িনি। বাসায় পত্রিকা এসেছে কিন্তু আমি ভাঁজ না খুলে পত্রিকাটি রেখে দিয়েছি এটি আগে কখনও ঘটেনি। গত শুক্র শনিবার আমার জীবনে এটা ঘটেছে– আমার পত্রিকাটা খুলতে ইচ্ছে করেনি। কারণ আমি জানতাম পত্রিকাটি খুললেই আমি দেখতে পাব সেখানে লেখা থাকবে হেফাজতে ইসলামের ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে হাই কোর্টের সামনে বসানো একটা ভাস্কর্য রাতের অন্ধকারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি এটাও জানতাম সেখানে সরকারের বড় বড় মন্ত্রীদের আরও বড় বড় বক্তব্য থাকবে যেখানে এই কাজটি সমর্থন করে অনেক কিছু বলা হবে। শুধুমাত্র মুখ ফুটে কেউ সত্যি কথাটি বলবে না মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এখন ভাস্কর্য বসানো যায় না। শুধু তাই না, বসানো হলেও হেফাজতে ইসলামকে সন্তষ্ট রাখার জন্যে সেটাকে রাতের অন্ধকারে সরিয়ে নিতে হয়।

আমার অবস্থা উট পাখির মতো। উট পাখি বালুর ভেতর মাথা ঢুকিয়ে রেখে যখন চারপাশের কিছু দেখে না তখন নাকি তার ধারণা হয় তাকেও কেউ দেখছে না। আমিও পত্রিকা পড়া বন্ধ করে দিয়ে যখন কোনো খবরই রাখছি না তখন মনে মনে ভাবছি, দেশেও বুঝি কিছু ঘটছে না। কিন্তু আসলে যা ঘটার সেটি ঘটে গেছে। জানতে পেরছি আমাদের কিছু তরুণেরা ঘটনাটি ঘটতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা এই দেশের ত্রিশ লক্ষ শহীদের পক্ষ থেকে এই ঘটনাটির প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছিল।

আজকাল আমার মাঝে মাঝেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসটির কথা মনে পড়ে। ষোল তারিখ বিকাল বেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। আমি পরদিন ভোর বেলা যাত্রাবাড়ী থেকে হেঁটে হেঁটে ঢাকা শহরে আসছি। চারপাশে নানা কিছু ঘটছে। তার মাঝে আমি একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছি, একবার ডানে এবং বামে তাকাচ্ছি এবং মনে মনে ভাবছি, এই যে আমার স্বাধীন বাংলাদেশ, এটি আমার দেশ। আমাদের আর কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, কোনো কিছু নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হবে না। আমরা যা যা স্বপ্ন দেখেছি তার সবকিছু এখন সত্যি হয়ে যাবে। আর কিছু নিয়ে কোনোদিন আন্দোলন বা সংগ্রাম করতে হবে না।

এখন আমি ভাবি এবং মনে হয় আমি কতই-না ছেলেমানুষ ছিলাম! কখনও কি ভেবেছিলাম মাত্র চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এভাবে হত্যা করা হবে? চার জাতীয় নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হবে? এক যুগ থেকে বেশি সময় দেশকে মিলিটারিরা শাসন করবে, দেশকে পুরো উল্টো পথে ঠেলে দেবে? সব যুদ্ধাপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে।

শুধু এখানেই শেষ হয়ে গেলে ইতিহাসটি হত দীর্ঘশ্বাসের, কিন্তু আমাদের খুব সৌভাগ্য এখানেই শেষ হয়নি। আবার মুক্তিযুদ্ধের সরকার এসে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার বিচার করেছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে দেশকে গ্লানিমুক্ত করেছে।

কিন্তু তারপর যখন দেখি সেই একই সরকার হেফাজতে ইসলামের সামনে প্রায় নতজানু হয়ে তাদের সব দাবি মেনে নিচ্ছে, পাঠ্যবই পরিবর্তন করেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না, এই দেশ থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যাচ্ছে, তখন আমি হিসাব মিলাতে পারি না।
২.
ভাস্কর্য একটি অপূর্ব শিল্পমাধ্যম। মনে আছে পোস্ট-ডকের অল্প কিছু বেতন থেকে টাকা বাঁচিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের ছয় মাসের ছেলেকে নিয়ে ফ্লোরেন্স গিয়েছিলাম মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিড দেখতে। কতবার ডেভিডের ছবি দেখেছি। কিন্তু প্রথমবার যখন সেই দীর্ঘ ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভ্যাটিকানে গিয়েছিলাম পিয়েতা দেখতে। এটি যখন মাইকেল অ্যাঞ্জেলো তৈরি করছিলেন তখন তার পরিচিতি ছিল না। তাই পিয়েতার বুকে তিনি তাঁর নামটি খোদাই করে রেখেছিলেন।

আমি লিখে দিতে পারি পৃথিবীতে একটি মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এই ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্যে অভিভূত হবে না।

যখন বয়স কম ছিল তখন এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াতে ক্লান্তি হত না। আমার কাছে নূতন একটি দেশ মানেই সেই দেশের মিউজিয়াম, সেই দেশের শিল্পকর্ম, সেই দেশের ভাস্কর্য। যাদের প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে শুধু তারাই বলতে পারবেন ভাস্কর্য কত সুন্দর। আমি যখন এই অপূর্ব ভাস্কর্যগুলোর সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থাকি তখন মনে মনে ভাবি, আমরা কতই-না সৌভাগ্যবান যে, মানুষ হয়ে জন্মেছি, তাই এই অপূর্ব সৌন্দর্যটি উপভোগ করতে পারছি।

শুধু ভাস্কর্য নয়, মিউজিয়ামে মিউজিয়ামে কত শিল্পীর কত পেইন্টিং। সাধারণ দর্শকেরা বিখ্যাত পেইন্টিংয়ের সামনে ভীড় করে দাঁড়ায়, আমি ঘুরে ঘুরে সুন্দর পেইন্টিং খুঁজে বেড়াই। প্রায় অপরিচিত একজন শিল্পী, কিন্তু তার অসাধারণ শিল্পকর্মের সামনে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিই আমাকে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য। সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষমতাটি দেওয়ার জন্যে।

কবিরা কবিতা লিখেন, সেই কবিতার আবৃত্তি শুনে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। মঞ্চে অভিনেতারা নাটক মঞ্চায়ন করেন, নাটকের পুরোটুকু অভিনয় জানার পরও আমরা চরিত্রগুলোর আনন্দে হাসি, দুঃখে কাঁদি, অবিচার দেখে ক্ষুব্ধ হই। মঞ্চে শুধু নাটক দেখি না নৃত্যানুষ্ঠান দেখি। সেখানে নৃত্যশিল্পীরা তাদের নাচের মুদ্রা দিয়ে আমাদের মোহিত করেন।

আমরা পৃথিবীর অসংখ্য বৈচিত্রময় শিল্পমাধ্যম উপভোগ করে এক ধরনের পূর্ণতা লাভ করি। যে মানুষটি শিল্পকে যত বেশি অনুভব করতে পারবে সেই মানুষটি তত পূর্ণ মানবসন্তান। মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে আমরা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতে পারি। একজন শিশুকে কখনও শেখাতে হয় না। তার বোঝার ক্ষমতা হওয়ার সাথে সাথে সে তার নিজের মতো করে সৌন্দর্য উপভোগ করতে শিখে যায়। মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে পৃথিবীর বাতাস যে রকম আমার বুকে টেনে নেবার অধিকার ঠিক একই রকম অধিকার একটি কবিতা লেখার, একটি কবিতা আবৃত্তি করার, একটি গান শোনার, একটি বাঁশি উপভোগ করার, একটি ভাস্কর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার।

পৃথিবীর কেউ আমাকে বলতে পারবে না তুমি এই শিল্পটি দেখে মুগ্ধ হতে পারবে না।

অথচ হেফাজতে ইসলাম বলছে আমরা কবিতা পড়তে পারব না, আমরা ভাস্কর্য দেখতে পারব না। তাদেরকে কে এ কথা বলার অধিকার দিয়েছে? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ দিয়ে আমরা এই বাংলাদেশটি পেয়েছি, লটারিতে জিতে এই দেশটি আসেনি। যে মুক্তিযোদ্ধারা নিজের প্রাণ দিয়ে এই দেশটিকে আমাদের উপহার দিয়েছেন তারা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন সেটিই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের সেই বাংলাদেশের কাঠামোর বাইরে যাবার কোনো অধিকার নেই। কোনো দল, কোনো গোষ্ঠী এসে ধর্মের দোহাই দিয়ে বলতে পারবে না বাংলাদেশকে পাল্টে দিতে হবে, দেশটিকে এখন সাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত করে ফেলতে হবে।

আজকাল কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দেওয়া হয়। হাইকোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি যখন দৃষ্টিসীমার বাইরে কোথাও নিয়ে স্থাপন করা হল তখন হেফাজতে ইসলাম যথেষ্ট বিরক্ত হল। তারা সেটিকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। ভাস্কর্য সরানোর ব্যাপারে তারা ধর্মের কোনো এক ধরনের ব্যাখ্যা দেয়। মেয়েরা হচ্ছে তেঁতুলের মতো, তাদের দেখলেই মুখে পানি চলে আসে, নারী জাতি সম্পর্কে এরকম একটি অপমানকর কক্তব্য আমি তাদের কাছেই শুনেছি। তাদের এই বক্তব্য ইসলাম ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা, সেটি আমরা কেমন করে জানি?

আমরা আমাদের দেশের কিছু তরুণকে হলি আর্টিজানে শুধুমাত্র বিদেশি হওয়ার কারণে অন্য অনেকের সাথে সন্তানসম্ভবা একজন মহিলাকে হত্যা করতে দেখেছি। শুধু তাই নয়, হিজাব না পরার কারণে তারা মেয়েদের হত্যা করেছে। সেই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নির্বিকারভাবে তারা রাতের খাবার উপভোগ করেছে। তারা এই কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে তাদের নিজস্ব এক ধরনের ধর্মবিশ্বাস থেকে।

মধ্যপ্রাচ্যের আইএস ইয়াজিদি মেয়েদের যৌনদাসী করে রাখার ব্যাপারে ধর্মের এক ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছে। নাইজিরিয়ার বোকো হারাম গোষ্ঠী শত শত স্কুলের মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। এই ভয়ংকর অমানবিক কাজটি করেছে ধর্মের এক ধরনের দোহাই দিয়ে। আজকাল প্রায় প্রতিদিনই দেখছি ইউরোপের কোনো না কোনো শহরে আত্মঘাতী তরুণেরা শত শত নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে অকাতরে হত্যা করছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, এই ধরনের কাজগুলোর ব্যাপারে তাদের নিজস্ব এক ধরনের ধর্মের ব্যাখ্যা আছে।

যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবার পর জামাত-শিবির চাঁদে সাঈদীর চেহারা দেখেছিল এবং সারা দেশে যে ভয়াবহ তাণ্ডব করেছিল তার পিছনেও তাদের নিজস্ব এক ধরনের ব্যাখ্যা আছে। শুধু তাই নয়, একজন ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করার জন্যে ঘাড়ের কোন জায়গায় কীভাবে কোপ দিতে হবে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে এবং সেটিও করা হয়েছে ধর্মের নামে।

কাজেই ধর্মের নামে কিছু একটা দাবি করলেই সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে কে বলেছে?

১৯৭১ সালে পাকিস্তান মিলিটারি এই দেশের তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল এবং এই ভয়ংকর গণহত্যা করা সম্ভব হয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। আমার বাবাকে পাকিস্তান মিলিটারি একটা নদীতীরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল। যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তাদের কাছে শুনেছি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি হাত তুলে খোদার কাছে তাঁর সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রার্থনা করেছিলেন (খোদা তাঁর প্রার্থনাটি শুনেছিলেন বলে এই দেশ একজন হুমায়ূন আহমেদ পেয়েছিল)। আমার বাবা অসম্ভব ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ ছিলেন। এই ধর্মপ্রাণ মানুষটির কাছে আমি সংগীত-শিল্প-সাহিত্য ভালোবাসতে শিখেছি। আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষ এক, সবাই সৃষ্টিকর্তার কাছে পরিত্রাণ চাইছে। শুধুমাত্র একেক ধর্মের পদ্ধতিটি একেক রকম, আর কোনো পার্থক্য নেই।

স্বাধীনতার পর আমার অসহায় মা তাঁর সন্তানদের নিয়ে একটি অকুল পাথারে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে আমি এতটুকু বিচলিত হতে দেখিনি। আমাদেরকে ধরে রাখার জন্যে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু তাঁর শক্তিটুকু এসেছিল সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল একটি বিশ্বাস থেকে। অসম্ভব ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ যে পুরোপুরি সেক্যুলার হতে পারে সেগুলো আমি আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে জেনেছি।

শুধু আমি যে আমার আপনজনের কাছে ধর্মের এই মানবিক রূপটি দেখেছি তা নয়, আমার পরিচিত প্রায় সবাই এরকম উদাহরণ দিতে পারবে। বহুকাল থেকে এই দেশের মানুষ ধর্মকর্ম করে এসেছে, কিন্তু ধর্মের এই বর্তমান অসহিষ্ণু রুদ্র রূপ কিন্তু আগে ছিল না।

কাজেই কোনো একটি দল ধর্মের একটি ব্যাখ্যা দিয়ে পুরোপুরি অযৌক্তিক, অমানবিক কিছু একটা দাবি করলেই সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে কে বলেছে? পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে যাই ঘটুক না কেন বাংলাদেশে সেটা ঘটতে পারবে না। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দিয়ে। যাদের প্রাণের বিনিময়ে এই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের বাইরে যাবার আমাদের কোনো অধিকার নেই। কাজেই যখনই কেউ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত করে তারা সরাসরি ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn