ইংলিশ চ্যানেলে মৃত্যুর মিছিল। সেখানে বোটডুবিতে কমপক্ষে ২৭ শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ফ্রান্স ও বৃটেনকে আলাদা করেছে সমুদ্রের যে অংশ, সেখানেই ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুরুতে ফ্রান্স জানায় কমপক্ষে ৩১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। পরে সংশোধন করে সরকারি এক কর্মকর্তা বলেন, এই সংখ্যা ২৭। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা। এ সময়ে সমুদ্রের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকে। এই সুবিধা পেয়ে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলীয় উপকূল থেকে বুধবার এসব অভিবাসী যাত্রা করেন।
কিন্তু পথে তাদেরকে বহনকারী একটি খালি ‘ডিঙ্গি’ এবং কিছু মানুষকে নির্জীব অবস্থায় ভাসতে দেখে এক ব্যক্তি উদ্ধারকারী বিভাগকে ফোন করেন। ফলে ফ্রান্স ও বৃটেনের যৌথ উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। এতে ব্যবহার করা হয় কমপক্ষে তিনটি বোট ও তিনটি হেলিকপ্টার। এই বোটডুবির সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে চার ব্যক্তিকে ফরাসি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমেনিন।
একে তিনি সবচেয়ে ভয়াবহ অভিবাসন বিষয়ক ট্রাজেডি বলে আখ্যায়িত করেছেন। উদ্ধার করা ব্যক্তিদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। তাদের ভয়াবহ হাইপোথার্মিয়া দেখা দিয়েছে। শরীরে উৎপন্ন তাপের চেয়ে কেউ যদি অস্বাভাবিকভাবে তাপ হারাতে থাকেন তাহলে তাকে হাইপোথার্মিয়া বলা হয়। যেসব মানুষ ওই বোটে ছিলেন তাদের পরিচয় সম্পর্কে জানা যায় নি। ওদিকে লন্ডনভিত্তিক সংবাদপত্র টাইমস বলেছে, নিহতদের মধ্যে একজন আফগানিস্তানের সেনা সদস্য। তিনি বৃটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। তার পরিবার লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তার সহায়তা প্রয়োজন ছিল তাদের। ফলে তিনি ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র অতিক্রম করার চেষ্টা করেন।
অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এ ঘটনাকে ইংলিশ চ্যানেলে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেছে। ২০১৪ সাল থেকে সংগঠনটি তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জ্যাঁ ক্যাস্টেক্স এই বোটডুবিকে একটি ট্র্যাজেডি বলে আখ্যায়িত করে শোক প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, যেসব অভিবাসী মারা গেছেন অথবা আহত হয়েছেন তারা মানবপাচারের অপরাধের শিকার। তাদের প্রতি আমার সমবেদনা।
উল্লেখ্য, বিপদ জানা সত্ত্বেও এ বছর ছোট ছোট বোট বা ডিঙ্গিতে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ঘটনায় মাঝে মাঝেই লন্ডন ও প্যারিসের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এসব মৃত্যুর ঘটনায় শোক ও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। লোকজনকে ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়া থেকে বিরত রাখতে আরো বেশি করার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রতি। আক্ষরিক অর্থেই মানবপাচারকারী চক্র এভাবে মানুষ ‘খুন’ করে পাড় পেয়ে যাচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। অন্যদিকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন বলেছেন, দেশে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য এই ইস্যুটি ব্যবহার বন্ধ করা উচিত লন্ডনের। জেরাল্ড ডারমানিন বলেছেন, এসব বিষয়ে বৃটেনের জবাব দেয়া উচিত।
উল্লেখ্য, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত অভিবাসী বোঝাই করে ‘ডিঙ্গি’ ছেড়ে দেয়। এর ফলে এসব মানুষকে নিয়ে ওইসব ডিঙ্গি বা বোট কোন রকমে ভেসে থাকে। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে দুলতে থাকে। সামান্য এদিক ওদিক হলেই তা ডুবে যায়। আর সলিল সমাধি হয় উন্নত ভাগ্যের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো অভাবি মানুষগুলোর। তবে এ জন্য উন্নত বিশ্বের সরকারগুলোর নীতিকে দায়ী করেছে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো এবং শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য নীতি অতি মাত্রায় কঠোর করা এবং অধিক নজরদারিতে রাখার কারণে মানুষ অবৈধপথে বিদেশে যাওয়ার ঝুঁকিকে বেঁছে নেয়। শরণার্থী এবং বাস্তুচ্যুত মানুষতের সাহায্যকারী একটি পরামর্শক গ্রুপ এল’অবারগে ডেস মাইগ্রেন্টস বলেছে, এসব কারণে শুধু পাচারকারীদের দায়ী করা হলে তা হবে বৃটেন ও ফ্রান্সের দায়িত্ব এড়ানো।
ফরাসি সরকারের তথ্যমতে, বছর শুরুর পর থেকে ৩১,৫০০ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছে। সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭৮০০ জনকে। তবে আগস্ট থেকে এই সংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন বলেছেন, সীমান্ত বিষয়ক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এজেন্সি ফ্রন্টেক্স-এর আরো অর্থ পাওয়া উচিত। যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখতে হয় এবং অভিবাসীদেরকে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলীয় উপকূল থেকে ফেরাতে হয় তাহলে তাদেরকে আরো অর্থায়ন করা উচিত। ম্যাক্রনের ভাষায়, ইংলিশ চ্যানেলকে একটি মৃত্যুপুরী হতে দিতে পারে না ফ্রান্স। বুধবার দিনের শেষের দিকে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এ সময়ে প্রাণহরণকারী এই সমুদ্র অতিক্রম বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৯২ বার