ইরান-ইরাকে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে
২০১৭ সালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ইরাক-ইরান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ পাওয়া খবরে অন্তত ৩৯৬ জন নিহত ও ৬ সহস্রাধিক আহত হওয়ার কথা জানা গেছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভূমিধসের কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যহত হচ্ছে। ইরানের স্থানীয় সময় রবিবার রাত ৮টা ১৮ মিনিটে ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং এর মূলকেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৩.৯ কিলোমিটার গভীরে। ভূমকম্পটি প্রধানত আঘাত হেনেছে ইরাকের আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলে। ওই অঞ্চলের সীমান্তে অবস্থিত ইরানের কুর্দিস্তান ও কেরমানশাহ প্রদেশও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা ফার্স জানিয়েছে, এ ভূমিকম্পে কেরমানশাহ প্রদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ওই প্রদেশে ১২৯ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ‘সারপোলে জাহহাব’ শহরে ৬৮ জন, ‘কাসরে শিরিন’ শহরে ৩৮ জন এবং কেরমানশাহ শহরে ২৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তিন সন্তানের জননী মাজিদা আমির বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, সন্তানদের নিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে পুরো ভবন কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছিল ভবনটি বাতাসে নাচছে। প্রথমে আমি মনে করেছিলাম বড় কোনও বোমার বিস্ফোরণ হয়েছে। পরে শুনলাম চারপাশের সবাই ভূমিকম্প বলে চিৎকার করছে।
কোকাব ফার্দ নামের ৪৯ বছরের এক গৃহিনী জানান, তিনি যে ভবনে বাস করতেন তা ভেঙে পড়ায় খালি হাতে দৌড়ে বের হয়ে আসেন। বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে কোনোমতে বেরিয়ে আসতে পারি আমি। কিছুই আনতে পারিনি। ৫১ বছরের রেজা মোহাম্মদি জানান, প্রথম কম্পনের সময় তিনি ও তার পরিবারের লোকেরা ঘর থেকে বের হয়ে গলিতে আশ্রয় নেন। কিছুক্ষণ পর ঘরে কিছু জিনিস আনতে গেলে আফটার শকে ঘর ভেঙে পড়ে। ইরাকি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশটির সুলাইমানিয়া প্রদেশে অন্তত ৩০ জন নিহত ও কয়েকশ’ মানুষ আহত হয়েছে।এ ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত ইরানেই আহত হয়েছে এক হাজারের বেশি মানুষ। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ভূমিকম্প কবলিত এলাকাগুলোতে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুররেজা রাহমানি ফাজলিকে নির্দেশ দিয়েছেন। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ জানিয়েছে, কুর্দি সরকার-শাসিত সুলাইমানিয়া শহর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে হালাবজার কাছে ভূমিকম্প প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। ভূমিকম্পের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, তা তুরস্ক, আরমেনিয়া, কুয়েত, জর্দান, লেবানন, সৌদি আরব, বাহরাইন ও কাতার থেকেও অনুভূত হয়। ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ভূমিকম্পের কেন্দ্রের দূরত্ব অনেক হলেও সেখানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বাগদাদের ভবনগুলো প্রচণ্ডভাবে কেঁপে ওঠে। অনেকে একে প্রথমে বিস্ফোরণ বলে মনে করলেও কম্পন এক মিনিটের বেশি সময় স্থায়ী হওয়ায় পরে একে ভূমিকম্প বলে বুঝতে পারে। ভূমিকম্পের পর কয়েক দফা আফটার শক হয়েছে এবং ইরানের কুর্দিস্তান, কেরমানশাহ, ইলাম, খুজিস্তান, হামেদান, পশ্চিম আজারবাইজান, পূর্ব আজারবাইজান, লোরেস্তান, তেহরান, কাজভিন, যানজান ও কোম প্রদেশ থেকে তা অনুভূত হয়। ইরানের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা জানিয়েছে, ভূমিকম্পের ফলে কেরমানশাহ প্রদেশে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন রয়েছে এবং ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া, গ্রাম এলাকার কিছু ঘর-বাড়ি ধ্বংসের খবর পাওয়া গেছে। ভূমিকম্পের পর ইরানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপক উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। এরইমধ্যে ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুর রেজা রাহমানি ফাজলি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসান হাজিজাদেহ কেরমানশাহ প্রদেশে পৌঁছেছেন। তারা ব্যক্তিগতভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা দেখভাল করছেন।
ইরানের সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল আব্দুর রহীম মুসাভি এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী জাফারি কেরমানশাহ প্রদেশের সারপোলে জাহাব শহরে পৌঁছেছেন। তারা দুজন ইরানের সামরিক বাহিনীর উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করবেন। সারপোলে জাহাব শহর এককভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরানি পুলিশের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন আশতারিও দুর্গত এলাকায় ছুটে গেছেন। এছাড়া, দুর্গত এলাকায় ১০০’র বেশি ডাক্তার পাঠানো হয়েছে। ভূমিকম্প দুর্গত লোকজনকে সাহায্যের জন্য ইরানের দ্রুত উদ্ধারকারী দল অনুসন্ধানী কুকুর নিয়ে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে খুঁজে দেখা হচ্ছে ধ্বংস্তুপের নিচে জীবিত কেউ আছে কিনা। রাজধানী তেহরানের হাসপাতালগুলোকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে যাতে আহত লোকজনকে আনার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়। আহত লোকজনকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে কমপক্ষে ৪৩টি অ্যাম্বুলেন্স, চারটি অ্যাম্বুলেন্স বাস এবং ১৩০ জন জরুরি টেকনিশিয়ানকে মেহরাবাদ বিমানবন্দরে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া, ইরানের বিমান বাহিনী আহত লোকজনকে দ্রুত হাসপাতালে আনার জন্য হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছে। ইরানের স্বেচ্ছাসেবীরা আহত লোকজনের জন্য রক্ত সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। এদিকে, ইরানের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনি, ইরানে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত মাইকেল ক্লর-বার্চটোল্ড, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সমবেদনা জানিয়েছেন।