ফয়সল আহমদ রুহেল :শাহ মোঃ আতাউর রহমান কামালী। একজন অনুকরনীয় শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি। এই গুণী শিক্ষকের আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় শিক্ষার্থীদের জীবন আলোকিত হয়। মানুষ গড়ার কারিগর এই শিক্ষক দীর্ঘ ৩৮ বৎসর শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিলিয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জগন্নাথপুর উপজেলায় সরকারি পর্যায়ে ২ বার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচিত হন। তিনি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার শাহারপাড়া শাহ কামাল হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শাহ মোঃ আতাউর রহমান কামালী সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার শাহারপাড়ার কামালশাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা- শাহ মোঃ আব্দুস সোবহান কামালী ও মাতা- শাহ ফজলুল নেছা কামালী। পিতা-মাতা বেঁচে নেই। তিনি ভাই ও বোন ৭ জনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান।
শিক্ষাজীবন : তিনি ১৯৬৪ইং সনে শাহ কামাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। এরপর একই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ইং সনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৬৯ইং সনে জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৭৫ইং সনে ছাড়পত্র নিয়ে ওসমানীনগর উপজেলার খুজগীপুর মানউল্লা হাইস্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৭৬ইং সনে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে বিজ্ঞান বিভাগে এস এস সি পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৮ইং সনে বিজ্ঞান বিভাগে সিলেট সরকারি কলেজ (বর্তমানে এম.সি কলেজ) থেকে এইচ এস সি পরীক্ষা ও একই কলেজ থেকে ১৯৮১ইং সনে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে বি. এসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি সকল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৮ইং সনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি.এড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনি ও উত্তীর্ণ হন।
শিক্ষকতা : তিনি ১৯৮২ইং সনের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮৩ইং সনের ৩১ মার্চ প্রায় ১ বৎসর শাহারপাড়া জুনিয়র হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর ১৯৮৪ইং সনের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৯০ইং সনের ৩ মে পযর্ন্ত প্রায় ৭ বৎসর সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি হাইস্কুলে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার শাহারপাড়া শাহ কামাল হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৯০ইং সনের ২ জুন থেকে ২০২০ইং সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারী পযর্ন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩০ বৎসর দায়িত্ব পালন শেষে অবসর গ্রহণ করেন।
দায়িত্ব পালন : শ্রদ্ধেয় শাহ মোঃ আতাউর রহমান কামালী সামাজিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুনামগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পরিচালক ছিলেন এবং জগন্নাথপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে প্রায় ২২বছর দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি সুনামগঞ্জ এর সহ সভাপতি, জগন্নাথপুর উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ স্কাউট জগন্নাথপুর উপজেলার সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরো এর সহ সভাপতি, বাংলাদেশ স্কাউট জগন্নাথপুর উপজেলার কমিশনার, জগন্নাথপুর ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং বডির অন্যতম সদস্য, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড সিলেটের পরীক্ষা কমিটির সদস্য, জগন্নাথপুর উপজেলার শিক্ষা কমিটির সদস্য, জগন্নাথপুর উপজেলার শিক্ষার মান উন্নয়ন কমিটির সদস্য, জগন্নাথপুর উপজেলার আইসিটি উন্নয়ন কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে শাহার পাড়া শাহ কামাল উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, জগন্নাথপুর উপজেলার আইন শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও সিলেট শহরের বৃহত্তর শাহারপাড়া সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
শিক্ষকতা জীবনের স্মরণীয় ঘটনাঃ এই গুণী শিক্ষক জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী হাইস্কুলের যখন শিক্ষক, তখন তিনি সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক ছিলেন। তিনি বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে পাঠদান করাতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করার জটিল কাজটি সাবলীলভাবে সহজেই করে নিতেন। শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে স্বপ্নকে সত্যি করার দায়িত্ব পালন করতেন। শিক্ষকতা জীবনের সেই সব ঘটনার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে এই শিক্ষক বলেন, ১৯৮৬ইং সনের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষা সবেমাত্র শেষ হয়েছে, যথারীতি উত্তরপত্র ও মূল্যায়ন করা হয়েছে, এখন ফলাফল প্রকাশের অপেক্ষা। তখনকার সময় নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল ফাইনাল পরীক্ষার চেয়ে কঠিন ছিল। নির্বাচনী পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশের জন্য প্রধান শিক্ষক মহোদয় স্টাফ মিটিং ডাকলেন। সকল শিক্ষকরা মিটিং এ বসলেন তখনকার সময়ে আমিসহ প্রায় অর্ধেক শিক্ষকই প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের ছাত্র ছিলেন। এক পর্যায়ে স্টার্ফ মিটিং এ ফলাফল পর্যালোচনা শুরু হলো। প্রধান শিক্ষক বললেন, আমি সব দেখলাম, মাত্র একজন ছাত্র কোনক্রমে পাশ করেছে, বাকী সবাই একাধিক বিষয়ে শোচনীয়ভাবে অকৃতকার্য হয়েছে। প্রধান শিক্ষক কতজন ছাত্রছাত্রী এসএসসি পরীক্ষার জন্য সিলেক্ট করা যাবে সে ব্যাপারে সকলের মতামত চাইলেন। বেশির ভাগ শিক্ষকই একজন ছাত্রকে ১৯৮৬ইং এসএসসি পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করার পক্ষে মতামত প্রকাশ করলেন। তাদের যুক্তি একের অধিক দিলে ফলাফল বিপর্যয় হবে। এমনকি শূন্য ফলাফল ও হতে পারে। তখনকার দিনে ৫০% এর নিচে বোর্ডের রেজাল্ট হতো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি স্যারের উপর ছেড়ে দিলাম। স্যার বললেন, আমি একটু সময় নেই তারপর সিদ্ধান্ত নিব। যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, আমি যদি একজন ছাত্রকে আগামী এসএসসি পরীক্ষার জন্য নিবার্চন করি তাহলে অভিভাবক ও গ্রামের মানুষের কাছে কি জবাব দেব? স্যার বললেন ২/১দিন পর ফলাফল প্রকাশ করব। পরের দিন স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, মাত্র ১৭ জন ছাত্র-ছাত্রী, আমি কাকে রাখব আর কাকে বাদ দিব। আমাকে বললেন, তুমি আমাকে একটু সহযোগিতা করতে হবে। আমি এই শ্রীরামসী হাইস্কুলের ছাত্র থাকাবস্থায় ক্লাসে ১ম ছিলাম। এই প্রধান শিক্ষক স্যার আমারই প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর এই শ্রীরামসি হাইস্কুলে জোর করে নিয়ে আসেন। সংগত কারণেই আমার উপর তিনির আস্থা ও বিশ্বাস বেশি ছিল। তিনি ফলাফল প্রকাশ করার আগে বললেন, তুমি গণিত ও বিজ্ঞান পড়াবে। আমি ইংরেজি ও অন্যান্য বিষয় পড়াবো। তিনি ফলাফল প্রকাশ করলেন। প্রধান শিক্ষক মহোদয় নিবার্চনী পরিক্ষায় অংশগ্রহণকারী সকল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ১৯৮৬ইং সনের এসএসসি পরিক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য নিবার্চিত করলেন।
শিক্ষকরা অসন্তোষ্ট, অভিভাবক প্রায় সবাই পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন। শিক্ষকরা শূন্য ফলাফলের আশঙ্কা করলেন। স্যার সকল ছাত্রকে বোর্ডিং করে নিয়ে আসলেন। সেই বৎসর ছাত্রী সম্ভবত ছিল না, থাকলে ১/২ জন হতে পারে। আমার এই মুহুর্তে স্মরণ হচ্ছে না। আমি গণিত ক্লাস শুরু করলাম। দেখলাম তাদের বেসিক জ্ঞান নেই। এভাবে কোনমতেই তাদের পাশ করানো যাবে না। ঝুঁকি একটা নিতেই হবে। আমি বিভিন্ন বোর্ডের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও বিভিন্ন বোর্ডের অধীনে ভাল ভাল স্কুলগুলোর নির্বাচনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পর্যালোচনা করে সংক্ষিপ্ত ৬০ মার্কের সাজেশন তৈরী করলাম এবং পড়াতে লাগলাম। ২/৩ দিন পর পর পরীক্ষা নিলাম। মোটামুটি উন্নতি হলো। পরীক্ষায় দেখা যায় ৯০% প্রশ্নপত্র আমার সাজেশন থেকে কমন পড়েছে। প্রত্যেক পরীক্ষার্থী খুবই খুশি। ১৯৮৬ইং সনের রেজাল্ট হলো। আমাদের স্কুলের ফলাফল ১৭ জন পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ১৫ জন পাশ। তখন বোর্ড ছিল কুমিল্লা। অভিভাবক ও শিক্ষকরা সবাই খুশি। শিক্ষকরা আমার সাজেশন দেখে অবাক হয়ে গেলেন। মনে হয় যেন আমার প্রশ্নটাই বোর্ড দিয়ে দিয়েছে। তখন এলাকায় আমার কদর একটু বেড়ে গেল। সকল অভিভাবকরাই তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসতেন পড়ানোর জন্য। আমার শিক্ষকতা জীবনের এই প্রশ্নপত্র বা সাজেশন নিয়ে এখনও চিন্তা করি। কিভাবে অলৌকিকভাবে হুবহু মিলে গেল।
পারিবারিক : মানুষ গড়ার কারিগর এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ২ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। বড় মেয়ে শাহ নিশাত তাসনীম কামালী, বড় ছেলে শাহ আহসানুর রহমান কামালী, ছোট মেয়ে শাহ মাইশা কামালী ও ছোট ছেলে শাহ আজওয়াদুর রহমান কামালী।
২০২৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত য্ক্তুরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকদের সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় জগন্নাথপুর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষককের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)। উল্লেখ্য, ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভূষিত করবে এ সংস্থাটি।
শ্রদ্বেয় শাহ মোঃ আতাউর রহমান কামালী দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সততা দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রলুদ্ধ করেন। তিনি শিক্ষকতা জীবনে এক আদর্শ জ্ঞানচর্চার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এই শিক্ষকের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৯১ বার