গতকাল পরলোকে চির বিদায় নিলেন সুনামগন্জের কৃতি সাংবাদিক জনাব শাহাবুদ্দীন আফিন্দী। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহী রাজিউন) এই মর্মান্তিক দু:সংবাদটি পেলাম আরেকজন উদিয়মান রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক, জগন্নাথপুরের কৃতি সন্তান সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জনাব মুক্তাদির আহমেদ মুক্তার পোস্ট থেকে (তিনি আমার শশুড় বাড়ীর দিকের আত্মীয়)। সংবাদটি বিগত কিছুদিনের নিকটাত্মীয় ও অতি পরিচিত অনেক গুনীজনের চির প্রস্থানের শোক বার্তার তালিকায় আরেকটি নামের সংযোগ দিল। সর্বগ্রাসী অনুবিক্ষন জীবানু করোনার আক্রমণের প্রারম্ভ থেকেই শুধু মৃত্যু সংবাদ। চারিদিকে চলছে কেবল স্বজন হারানোর আহাজারী, বেদনা আর নিরব কান্না। সম্প্রতি করোনার সাথে তাল মিলিয়ে মরণ ব্যাদি ক্যান্সার কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। মৃত্যু শোকের মিছিল যেন আর থামতে চায় না।

শাহাবুদ্দীন ভাইর মৃত্যু এমনি একটি আকস্মিক সংবাদ। তিনি ছিলেন আমাদের অধিনায়ক। আমি সুনামগন্জ সরকারী জুবিলী হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই ও মুসলিম হোস্টেলে আবাসন নেই ১৯৭৫ সনের জানুয়ারী মাসে। শারিরীক গড়নে আমি সব সময়ই ছিলাম পিচ্ছি টাইপের। কিন্তু বাছালতা রোগের কারণে আফিন্দী ভাই এবং অন্যান্য সিনিওর ভাইদের কাছ থেকে একটু বাড়তি আদর, স্নেহ পেতাম। হোস্টেলে থাকার অভিজ্ঞতা আমার জীবনের একটি ব্যতিক্রমী অধ্যায়। কাঠের ফ্রেমের উপরে স্থাপিত পুরান কোর্টের সারি সারি অট্টালিকা আর পৌরসভা ভবনের পিচনে দীঘি-সম বিরাট পুকুরের অপর পাড়ে, গভ্ট স্কুল ঘেসা লন্চ ঘাট গামী পাকা রাস্তার ধারে, বিরাট বিরাট খেজুর গাছ বেস্টিত এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও মনোরম পরিবেশে ছিল ছাত্রাবাস বিল্ডিং এর অবস্থান। ষাট ও সত্তর দশকের কিংবদন্তি শিক্ষক পিআই স্যারের কঠুর শাসন ও তত্বাবধানে মুসলিম হোস্টেলে আমরা ছিলাম প্রায় ৩৫ জন ছাত্র। সে সময় শৃংখলা, অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল ছাত্রাবাসের আমাদের দৈনন্দিন জীবন।

৭৫ সনে শাহাবুদ্দীন আফিন্দী ভাই ছিলেন ৯ম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের চার বছরের সিনিওর। তাঁর ব্যাচ মেইট ছিলেন: সৈয়দ মুহাদ্দিস ভাই, শামছুল হক চৌধুরী ভাই, এনাম ভাই, মুজিব ভাই সহ অনেকে। শাহাবুদ্দীন ভাই ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী একজন সুদর্শন ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সুপুরুষ। কথিত আছে যে অনেকদিন আগে দৈহিক গড়ন ও পেশী শক্তি প্রতিযোগিতায় উনার বাবা একজন লৌহ-মানব খেতাবে ভুষিত হন। অনেকটা তাঁর পিতার মতই ছিল তার দেহ ও পেশী শক্তি। তিনি ছিলেন আমাদের স্কুলের বয়েজ স্কাউটের ট্রেইনার। মাথায় আর্মির টুপী, ইস্ত্রি করা সাদা পোশাক, শার্টের দুই কাঁধে গোলাকৃতি মেডেল ও বগলের নীচে মোটা কালো রশিতে ঝুলানো বাঁশীতে তাঁকে দারুণ মানাত। দেখতে মিলিটারী অফিসারের মত লাগত। মনে পড়ে সে সময় উনার সাথে বয়েজ স্কাউটে নেতৃত্ব দিতেন দুই লিটন ভাই (বিডিআর বিদ্রুহে নিহত লেফ্টেনেন্ট কর্ণেল এলাহী মন্জুর চৌধুরী লিটন ও এ্যডবুকেট হায়দার চৌধুরী লিটন), দেওয়ান শেরজাহান রাজা ভাই ও কাজী রফিক ভাই প্রমুখ ছাত্র নেতারা। স্কুলের সামনে খালি জায়গায় চলত প্রশিক্ষন আর জাতীয় দিবসগুলিতে কুচকাওয়াজ। সে ছিল এক বিরাট আনন্দ, উদ্দিপনা আর গর্বের দৃশ্য।

ছাত্রাবসের পিছন দিকে পিআই স্যারের বাসার বিপরীতে ছিল এক বেডের একটি ছোট্ট কামড়া। সেটা ছিল মনিটার রোম। প্রতি বছর সকল ছাত্রের প্রত্যক্ষ ভোটে দশম শ্রেণীর একজন মনিটার (অধিনায়ক) নির্বাচিত হতেন। ১৯৭৭ সনে শাহাবুদ্দীন ভাই মনিটার নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন অতি সৎ সাহসী একজন ছত্র নেতা। একদিন লক্ষণশ্রীর কোন এক বখাটে যুবক এলাকার দাপট দেখিয়ে পিআই স্যারকে অপমানের চেস্টা করে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই পশ্চিম বাজারের নুরজাহান সিনেমা হলের সামনে থেকে শাহাবুদ্দীন ভাই তাকে জুরপূর্বক রিক্সায় উঠিয়ে হোস্টেলে নিয়ে আসেন। সে তার বেয়াদবির জন্য স্যারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়। তার অভিভাবকরা অনেকটা মূলচেকা দিয়ে হোস্টেল থেকে তাকে ছাড়িয়ে নেন।

সে সময় ছাত্রাবাসের অনেক ঘটনাতেই সঠিক নেতৃত্ব দেন শাহাবুদ্দীন ভাই। মেট্রিক পাশের পর তিনি সুনামগন্জ কলেজে লেখাপড়া করেন। তাঁর চারিত্রিক বৈশিস্ট বিকাশের ধারাবাহিকতায় তিনি সুনামগন্জের বিভিন্ন অঙ্গনে পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেন। একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক হিসাবে সুনামগন্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক “হিজল- করচ” পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গতকাল অকালে মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুতে সুনামগন্জ এবং তাঁর জন্মস্থান ভীমখালির ঐতিয্যবাহী “বিছনা” গ্রাম একজন সুহৃদ বন্ধু ও সুনাগরিককে হারাল। আল্লাহ উনার বিদেহী আত্মাকে জান্নতবাসী করুন এবং উনার শোক-সন্তপ্ত পরিবারকে এই বিশাল ক্ষতি কাটিয়ে উঠার ধর্য্য ও তৌফিক দান করুন।

আমিন।

রোয়াব উদ্দিন। লন্ডন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn