একটি সত্য ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। সালটি সম্ভবত ২০১৫ সাল। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জন মহিলা শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। সেই বিভাগের সভাপতির তাতে চরম আপত্তি। ওই দুই মহিলাকে কোনও কোর্সও দেন না,বসার জায়গাও না। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি আমার দৃষ্টিগোচর হলে আমি এই বিষয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে জানতে চাই। তাঁর হস্তক্ষেপে বিষয়টির মীমাংসা হয় এবং এর প্রতিবাদে বিভাগের সভাপতি নিজ দায়িত্ব হতে ইস্তফা দেন। আর একটি বড় মাপের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। একজন বিভাগীয় সভাপতি নিজ অফিস কক্ষে বসেন না কারণ সেখানে জাতির পিতা আর প্রধানমন্ত্রীর ছবি রয়েছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পর হতে কোনও জাতীয় দিবস পালন করা হয়নি কখনও জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়নি। সেখানেও আমাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। অবস্থা এমন চলতে থাকলে খুব সহসা কোনও একটি মহল থেকে এমন দাবিও উঠতে পারে ১৯৯১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নারী দেখতে দেখতে ক্লান্ত। এখন দেশের মানুষ একজন পুরুষ প্রধানমন্ত্রী দেখতে চায়।
চোখের সামনে অনেক কিছুই ঘটছে অনেক কিছু ঘটার বাকি আছে। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগে বর্তমানে বাস্তবে ক’জন আওয়ামী লীগের আদর্শ ধারণ করেন তা গবেষণা করে বের করতে হবে।নারী যদি পুরুষের সাথে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে পারে তাহলে তিনি একজন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানোর জন্য দেওয়া ‘গার্ড অব অনারে’ কেন সেই নারী উপস্থিত থাকতে পারবেন না? এটা তো কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। যেমন নয় বিবাহ রেজিস্ট্রি। ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও এমন সিদ্ধান্ত কি নেওয়া সমীচীন? যারা ইসলাম নিয়ে জিগির তুলেন,ওয়াজের নামে রাত-বিরাত গলা ফাটান তাদের অধিকাংশের ইসলাম নিয়ে অজ্ঞতা পর্বতসম। বর্তমানে তথাকথিত ইসলামি শিক্ষায় জ্ঞান বিজ্ঞান, দর্শন যুক্তি তর্ক নিয়ে কোনও চর্চা হয় না। অষ্টম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় ইসলামের স্বর্ণ যুগ। বিশ্বের অনেক মুসলমান জ্ঞান তাপস এই সময়ে তাদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন, অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপসহ সারা বিশ্বে আলো জ্বালিয়েছেন।
গত এপ্রিল মাসে সৌদি আরবের স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ‘রামায়ণ’’ ও ‘মহাভারত’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সৌদি আরবের বর্তমান শাসক প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান তার দেশের জন্য ভিশন ২০৩০ রচনা করেছেন। ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ যত না ধর্মীয় গ্রন্থ তার চেয়েও বেশি তা সাহিত্য কর্ম বলে স্বীকৃত। এই দু’টি গ্রন্থ স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে বর্তমান প্রজন্ম ২০৩০ ভিশন অর্জন করতে হলে তাদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে এবং সারা বিশ্বে কী ঘটছে তা জানতে হবে। নতুন পাঠ্যসূচিতে যোগ ব্যায়াম ও আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ায় মহাভারত তাদের জাতীয় মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত। ঋগবেদ ও মহাভারতে বর্ণিত গরুর পাখি সেই দেশের জাতীয় প্রতীক।
এই সম্পর্কে আমাদের ‘ওয়াজি মোল্লা’দের কাছ হতে কিছু শোনা যায়নি কারণ তাদের অজ্ঞতা।অনেক সময় সেনাবাহিনীতে প্রয়োজনে গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দেন কোনও একজন মহিলা অফিসার। তাতে কি ধর্মের কোনও ক্ষতি হয়? অনেকে প্রশ্ন তুলেন কোনও ব্যক্তির জানাজায় কোনও মহিলা অংশ গ্রহণ করতে পারেন কিনা? এই প্রসঙ্গে নানা মতবাদ আছে তবে কোনও মতবাদেই তাদের অংশ গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়নি। ইসলামের প্রচলিত চারটি মতবাদেই বলছে কোনও ব্যক্তির জানাজায় অংশগ্রহণ করতে মহিলাদের বারণ করা হয়নি। বিভিন্ন হাদিসে খুঁজলে তা পরিষ্কার ভাবে বুঝা যাবে। কোনও কোনও মতবাদে বলা হয়েছে জানাজার সময় মহিলারা পেছনের কাতারে দাঁড়াবেন, কোনোটাতে বলা হয়েছে শুধু মসজিদে জানাজা হলে মহিলারা তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারেন, আবার কোনও কোনও মতবাদে বলা হয়েছে মহিলাদের মরদেহের সঙ্গে কবর পর্যন্ত যাওয়াটা সমীচীন নয়। জানাজা কোনও নামাজ নয় এটি মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া। পাকিস্তান সহ প্রায় প্রত্যেকটি আরব দেশেই মহিলারা জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তানের নারী নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হলে তার কন্যা সামনের কাতারে মায়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। কেউ তাতে আপত্তি করেননি। যারা পবিত্র হজব্রত পালন করতে গিয়েছেন তারা দেখেছেন প্রায় প্রত্যেক ওয়াক্তের পর জানাজা হয় এবং তাতে নারী পুরুষ সকলেই অংশগ্রহণ করেন। কেউ না করতে চাইলে তাকে বাধ্য করার কোনও নিয়ম নেই। এক সময় এই দেশে মহিলাদের মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার বিধান ছিল না। এখন অনেক মসজিদে মহিলাদের নামাজ পড়ার পৃথক ব্যবস্থা আছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ।শেখ হাসিনার শাসনামলে এই দেশে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্র অর্জন আকাশচুম্বী। দেশের এমন কোনও পেশা নেই যেখানে নারীদের বিচরণ নেই এবং তারা পুরুষদের পাশাপাশি সফলও হচ্ছেন। সেই দেশে একজন মহিলা ইউএনও কোনও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ‘গার্ড অব অনারে’ উপস্থিত থাকতে পারবেন না এটি একটি অবিশ্বাস্য কথা। শাজাহান খানের মতে অনেকেই নাকি এটা চায় না। এই ‘চাই না’র দলে যারা আছেন এরা কারা? এদের সঙ্গে হেফাজতিদের তফাৎ কোথায়? অনেকই অনেক কিছু চায় না। করোনা যখন শুরু হয় তখন কোনও রোগীর মৃত্যু হলে তাকে অনেক কবরস্থানে কবর দেওয়া হতো না। কয়েকটি কবরস্থানে এই ব্যাপারে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতে কি মৃত ব্যক্তির কবর দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
যারা নারীদের নানা ভাবে অসম্মান করেন তাদের মতলব ভালো নয়। ইসলাম একজন নারীকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে তা অন্য যে কোনও ধর্মের সাথে অতুলনীয়। সুতরাং শাজাহান খানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যখন কোনও জনবিরোধী ও কুপরামর্শে অংশগ্রহণ করেন তখন তা বেদনাদায়কও বটে। এমনটি চলতে থাকলে কোনও এক সময় দাবি উঠবে নারী প্রধানমন্ত্রী চাই না যেটি জামায়াতে ইসলামের শ্লোগান। অতএব সাধু সাবধান।সব শেষে একটি আশঙ্কার কথা বলি। বঙ্গবন্ধুর শত্রু ঘরের ভেতরেই ছিল তিনি বুঝতে পারেননি। আশা করি তাঁর কন্যা এই ভুলটা করবেন না। আর তেমনটা যদি হয় সামনে সব অন্ধকার। লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক